অর্ঘ্য ঘোষঃ
সাংবাদিকতায় হাতেখড়ির সময় থেকেই কাঞ্চনদার সঙ্গে আমার পরিচয়। তখন আমি সবে সাপ্তাহিক ‘দিদিভাই’ পত্রিকায় লেখালিখি শুরু করেছি অন্যান্য পত্রিকার সঙ্গে ‘দিদিভাই’ দফতরে আসত ‘নয়াপ্রজন্ম’ পত্রিকাও। পত্রিকাটি দেখে লেখার আগ্রহ বোধ করি। একদিন ঢেকা স্বাস্থ্যকেন্দ্র সম্পর্কিত একটা লেখা নিয়ে পত্রিকা দফতরে দেখা করতে যাই। কাঞ্চনদা তখন প্রূফ দেখছিলেন। পরিচয় দিয়ে লেখাটা তাঁর হাতে তুলে দিই। সেখানে তখন আরও অনেকেই ছিলেন। লেখাটা চোখ বুলিয়ে কাঞ্চনদা সবার সামনেই আমার মুখের একরাশ বিরক্তি উগরে দেন, ‘এটা কি লেখা হয়েছে?’ জনৈক নেতা, ‘মহাশয় আমার কাগজে এসব চলে না। সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলতে হবে। সংবাদের ভাষা হতে হবে আমজনতার মতো।’ অপমানে মুখ লাল করে ফিরে আমি। লজ্জায় লেখাটা ফেরত পর্যন্ত চাইতে পারিনি। একদিন সবিষ্ময়ে লক্ষ্য করি ‘আমদরবার’ বিভাগে লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে। তারপরেও দীর্ঘদিন সম্পাদকীয় পাতায় গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়েছে আমার লেখা। জানিনা, ‘সাদাকে সাদা, কালোকে কালো’ কিম্বা ‘আমজনতার মুখের ভাষা’ ব্যবহারে অভ্যস্থ হয়ে উঠতে পেরেছি কিনা, কিন্তু তাঁর কথাটা ভুলিনি। পেশাগত কারণে দীর্ঘদিন আগে তাঁর কাগজে আর লেখালিখি করা হয়নি। তবু যোগসূত্রটা ছিন্ন হয়নি। মাঝেমধ্যেই ফোনে কথা হয়েছে।
কাঞ্চনদা খুব একরোখা মানুষ ছিলেন। যা করবেন ঠিক করতেন তাই করেই ছাড়তেন। তবে সেইভাবে বোঝালে বুঝতেন। একবার জেলার এক বর্ষীয়ান সাংবাদিকের ব্যক্তি এবং সাংবাদিক জীবন সম্পর্কে ধারাবাহিক ভাবে নয়াপ্রজন্ম পত্রিকায় লেখা প্রকাশ করতে শুরু করেছিলেন। বলাবাহুল্য সেইসব লেখা অনেকটাই ছিল ব্যক্তি আক্রমণাত্মক। সেই সাংবাদিক এবং কাঞ্চনদা, দুজনেরই আমি খুব স্নেহধন্য। ব্যাপারটা আমার খুব খারাপ লেগেছিল। ফোন করে কাঞ্চনদাকে বলেছিলাম, এটা কী করছেন দাদা? কারও ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে কুৎসা করছেন কেন? তাঁর পরিবারের লোকেদেরও এর ফল ভোগ করতে হবে। বরং উনি যেসব ভুল করেছেন সেইসব কাজ আপনি সাংবাদিক হিসাবে ঠিকঠাক করে দেখিয়ে দিন। বলা বাহুল্য কাঞ্চনদা আমার কথা শুনে রুষ্ট হয়েছিলেন। উড়িয়ে দিয়েছিলেন। আহত হলেও কিছু বলিনি। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে লক্ষ্য করেছিলাম দ্বিতীয় কিস্তিতে ‘চলবে’ লেখা থাকা সত্ত্বেও তৃতীয় কিস্তিতে সেই লেখা আর বেরোয়নি। আমি ধন্যবাদ জানানোর আগেই কাঞ্চনদা ফোন করে বলেন, ‘অর্ঘ্য, ভেবে দেখলাম তোমার কথাই ঠিক। তাই লেখাটা বন্ধ করে দিলাম।’
পরবর্তীকালে কাঞ্চনদা সেই সাংবাদিককেই সংবর্ধনা দিয়েছিলেন। পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা করেছিলেন। আমিও লিখেছি সেই সংখ্যায়। নির্ধারিত সাত কিস্তির সেই লেখা দ্বিতীয় কিস্তিতে বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণটি আমরা দু’জন ছাড়া কেউ জানতেন না এতদিন। কাঞ্চনদার মৃত্যুর সংবাদ অধিকাংশ সংবাদমাধ্যমেই প্রকাশিত হয়েছে। জীবদ্দশায় ওইসব সংবাদমাধ্যমের প্রতি কাঞ্চনদার একটা নীরব অভিমান ছিল। নিজে প্রচারলোলুপ ছিলেন না। তিনি চাইতেন তাঁর কর্মকাণ্ডের কথা প্রচারের আলো পাক। মানুষের কাছে পৌঁছাক। কিন্তু সেদিকটা অবহেলিত থেকে গিয়েছিল বলে তাঁকে আক্ষেপ করতে শুনেছি। সেটা হলে তিনি অনুপ্রাণিত হতেন। আমরা হয়তো তাঁর কাছে আরও কিছু পেতাম। আমি আমার সাধ্যের মধ্যে যতটুকু পেরেছি তাঁর কাজের কথা তুলে ধরেছি। আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘কৃতিকথা’ বিভাগে তাঁকে নিয়ে লেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেছি। তিনি এড়িয়ে গিয়ে বলেছেন, ‘আমাকে নিয়ে নয়, আমার যেসব প্রতিষ্ঠান আছে সেসব নিয়ে লেখো।’
নিজেকে প্রচারের আলোয় আনতে না চাইলেও জেলার অনেক সাহিত্য কিম্বা সাংস্কৃতিক কর্মীকে নিয়ে আনন্দবাজারের ‘ব্যক্তিত্ব’, ‘কৃতিকথা’ বিভাগে লেখার সুপারিশ করেছেন, তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন। যথাসময়ে সেসব লেখা প্রকাশিত হয়েছে। ওইসব ব্যক্তিরা হয়তো জানেনও না তাঁদের প্রচারের আলোয় নিয়ে আমার নেপথ্য কারিগরটির এহেন ভূমিকার কথা।
বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আমাকে সংবর্ধনা দিতে চেয়েছে। সংবর্ধনার মানপত্রে যেসব গুণাবলীর কথা লেখা থাকে আমি যদি তার যোগ্য না হই, যদি বিচ্যুত হই, সেই আশংকা থেকে সবিনয়ে এড়িয়ে গিয়েছি। কাঞ্চনদাও বিভিন্ন সময়ে আমাকে সংবর্ধনা দিতে চেয়েছিলেন। সর্বশেষ ‘বসুন্ধরা’ মঞ্চের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও একই ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিলেন। আমি যথারীতি সবিনয়ে জানিয়াছিলাম, দাদা আমি মনে করি সংবর্ধনা ফুরিয়ে যাওয়ার আগে নেওয়া উচিত। কেন আমাকে এরই মধ্যে ফুরিয়ে যেতে বলছেন? আগে যোগ্য হই তারপর সংবর্ধনা নেওয়ার কথা ভাববো। কাঞ্চনদা স্বভাবোচিত বকুনি লাগিয়েছিলেন, সংবর্ধনা যাঁরা দেন তাঁরা যোগ্যতা বিচার করেই দেন। তুমি এসো তো। তাঁর মুখের উপরে কিছু বলা হয়নি। যথারীতি যেতেও পারিনি। পরে শুনেছি আমি যাচ্ছি ধরে নিয়েই আমার মানপত্র-স্মারকে, আমার নাম লেখা পর্যন্ত হয়ে গিয়েছিল। অনুষ্ঠানসূচীতে নামও ছাপা হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই রাগ হওয়ারই কথা। কাঞ্চনদাও রাগ করে কিছুদিন কথা বলেননি। বরফ গলতে অবশ্য দেরি হয়নি। ভেবেছিলাম যদি কোনদিন সংবর্ধনা নেওয়ার মতো যোগ্য হয়ে উঠতে পারি তাহলে প্রথম কাঞ্চনদার হাতে থেকেই নেব। সেই ইচ্ছেটা অপূর্ণই থেকে গেল।