কাঞ্চন

অতনু বর্মনঃ

কবে কখন প্রথম আলাপের আলো পড়েছিল চোখে তা আজ আর মনে পড়ে না। সম্ভবত প্রথমে শুধু নামটাই শুনেছিলাম, সে অনেক কাল আগে ডাকযোগে আসা একটা পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে। কাঞ্চন সরকার। বেপরোয়া দুঃসাহসী স্বেচ্ছাচারী এক যুবক। গাল ভর্তি কালো দাড়ি, সেই অতকাল আগে বাচ্ছাদের স্কুলব্যাগের মতো পিঠে একখানা কালো ব্যাগ। বাইক আরোহী সেই যুবক সারাদিন চক্কর দেয় বীরভূমের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। সে নিজেই একটা জলজ্যান্ত খবর। কখনো তার কোমরে দড়ি পরিয়ে সদর সিউড়ী শহরের রাস্তায় ঘোরানো হয়, সে নিজেই সে কথা লেখে নিজের কাগজে। পরিকল্পনা আমরা সকলেই করি, সে শুধু পরিকল্পনাকে কল্পনার বাইরে নিয়ে এসে ভাবনাকে রূপ দিয়ে দেখায়। তার অসাধ্য কিছু নেই। কখনো হঠাৎ করেই চারচাকা নিয়ে হাজির হয় আমার বাড়িতে, এখনি নাকি তার সঙ্গে যেতে হবে। অগ্রাহ্য করি সাধ্য কি, সে কোন ওজর শুনতে তো। আমাকে আমোদপুর থেকে তুলে সিউড়ীতে উত্তমের বাড়ি। উত্তমকে গাড়িতে উঠিয়ে সোজা ওর গ্রাম। সেখানে তখন অনুষ্ঠান চলছে। আমাদের কে নামিয়ে আবার ছোটে তার গাড়ি। তুলে নিয়ে আসে আরও শিল্পী। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে সে ঘটিয়ে দিতে পারে জমজমাট ফাংশন। তার নাম কাঞ্চন। কাঞ্চন সরকার।

আমার প্রথম আঞ্চলিক ভাষার কবিতার ক্যাসেট বের করার পরিকল্পনা ছিল তার। কলকাতায় মাভাস কোম্পানীতে একই দিনে আমার কবিতা আর হেমন্ত ব্যানার্জীর গান রেকর্ড হলো। দুটোই বেরলো না। ওর অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারলাম না, আমি নিজে আপত্তি জানিয়ে বন্ধ করে দিলাম আমার ক্যাসেট প্রকাশ। আমার বিরুদ্ধে মামলা করতে ছুটল সে। যদিও মামলা ধোপে টিকল না। আমার ক্যাসেট আমি প্রকাশ করলাম নিজের উদ্যোগে। মাভাস কোম্পানীর মালিক অনুপ ঘোষ মামলা করলেন কাঞ্চনের নামে। মামলা চলাকালীন বাস দুর্ঘটনায় মারা গেলেন অনুপ ঘোষ। হাসপাতাল থেকে মর্গ মৃত অনুপ ঘোষের পাশে তবুও একজনই। কাঞ্চন সরকার।

সিউড়ী রবীন্দ্রসদনে তখন চলছে সম্মিলিত উদ্যোগে প্রতিমাসের থিয়েটার। বিক্রির জন্য রেখে আসা আমার ক্যাসেট টেবিল থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো তারই উদ্যোগে, অথচ শুভেন্দু মাইতির হাতে আমার ক্যাসেট পৌঁছে দিতে গেল সে নিজেই। শুভেন্দু দা আমোদপুর স্টেশন থেকে সিউড়ী আসবেন, কাঞ্চনের পরিকল্পনায় তার সফরসঙ্গী আমি। কাঞ্চন সরকার তাঁকে বাড়ি বয়ে ক্যাসেট পৌঁছে দিয়েছে শুনে হতবাক আমি বুঝতে পারিনা এ কেমন ধারা মানুষ। সেই আবার আমার দ্বিতীয় ক্যাসেট ‘পাবলুর মা ঘুমিঙ গেলা’ প্রকাশের পর বিক্রি করবার জন্য আমোদপুর এসে নিয়ে গিয়েছে ব্যাগ ভর্তি করে। আমার স্ত্রী তনুশ্রীর সঙ্গে তার দিনরাত ঝগড়া হতো, ওদের তুমুল চিৎকার চেঁচামেচি শুনে মনে হতো যেন এরা দুজন জন্মশত্রু অথচ তনুশ্রীর মৃত্যু পরবর্তীকালে সিউড়ী হাসপাতাল থেকে বক্রেশ্বর শ্মশান পর্যন্ত এক মুহূর্তের জন্যেও যে অনুপস্হিত থাকেনি তার নামও কাঞ্চন সরকার।

নন্দন দত্ত প্রকাশ করেছিল আমার ‘নামাবলী’ নামে একটি ছড়াই বই। ওকে নিয়ে সেখানে লিখেছিলাম—‘প্রচুর বিক্রি তাই জেনে রাখা দরকার / অভীক আর কাঞ্চন দুজনেই সরকার।‘ কথাটা অতিরঞ্জিত ছিল না। বীরভূম জেলায় সত্যিকারের প্রচুর বিক্রি হওয়া সংবাদ সাপ্তাহিকী ‘নয়াপ্রজন্ম’ দেখিয়ে দিয়েছিল যে, এও সম্ভব। কাগজটাকে একটা শক্ত জমিতে দাঁড় করানোর পর কাঞ্চন মেতে উঠলো বিচিত্র সব কর্মকাণ্ড নিয়ে। সবুজের অভিযান, বসুন্ধরা মঞ্চ প্রকৃতি তার অনমনীয় জেদের ফসল। আরও অজস্র পরিকল্পনা ছিল। মাঝে মাঝেই মধ্যরাতে আমার ঘুম ভাঙলো উজ্জ্বল হকের ফোন পেয়ে। উজ্জ্বল জানতে চাইছিল আমি কিছু জানি কিনা। জানতাম না, সত্যিই জানতাম না এভাবেও চলে যাওয়া যায়। কাঞ্চন সেই অসম্ভবকেও সম্ভব করে চলে গেল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *