লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর রহস্যজনক মৃত্যু: এক অবিশ্বাস্য অধ্যায়

নয়াপ্রজন্ম প্রতিবেদনঃ

লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ছিলেন ভারতের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী এবং একজন সৎ, নির্লোভ ও দূরদর্শী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তাঁর নেতৃত্ব দেশবাসীর মন জয় করে। তাঁর দেওয়া স্লোগান “জয় জওয়ান, জয় কিষাণ” আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। কিন্তু তাঁর মৃত্যু ঘিরে যে রহস্যের জাল রয়েছে, তা আজও পুরোপুরি উদ্ঘাটিত হয়নি।

তাসখন্দ চুক্তি ও মৃত্যুর আগের ঘটনা

১৯৬৬ সালের ১০ জানুয়ারি, উজবেকিস্তানের তাসখন্দ শহরে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইউব খানের সঙ্গে এক শান্তি চুক্তিতে সই করেন লাল বাহাদুর শাস্ত্রী। যুদ্ধশেষে শান্তি স্থাপনের লক্ষ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষর হয় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যস্থতায়।

চুক্তি স্বাক্ষরের কিছু ঘন্টার মধ্যেই গভীর রাতে (১১ জানুয়ারি), শাস্ত্রী হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হন বলে জানানো হয় এবং তাঁর মৃত্যু ঘটে। যদিও চিকিৎসকেরা দাবি করেন এটি ছিল “হার্ট অ্যাটাক”, কিন্তু ঘটনার পর থেকে তাঁর মৃত্যু ঘিরে নানা প্রশ্ন উঠে আসে।

রহস্যের ইঙ্গিত

শাস্ত্রীর পরিবারের অনেক সদস্যই সন্দেহ প্রকাশ করেন যে তাঁর মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না। মৃত্যুর পর তাঁর দেহে নীল ছাপ দেখা গিয়েছিল, যা বিষক্রিয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয় না। তাঁর স্ত্রী ললিতা শাস্ত্রীও একাধিকবার সংবাদমাধ্যমে দাবি করেন, তাঁর স্বামীর জলের ফ্লাস্কে বিষ মেশানো হতে পারে।

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হল, শাস্ত্রীর ময়নাতদন্ত (postmortem) কখনও হয়নি। একজন জাতীয় নেতার হঠাৎ মৃত্যু হলেও কেন ময়নাতদন্ত করা হল না — এই প্রশ্ন আজও উত্তরবিহীন।

তথ্যচাপা দেওয়া ও সরকারের নীরবতা

এই সমস্ত সন্দেহজনক মৃত্যুগুলি তদন্তের আওতায় আনতে সরকার কোনো দৃঢ় পদক্ষেপ নেয়নি। শাস্ত্রীর মৃত্যুর ঘটনায় RTI-এর জবাবের মাধ্যমে সরকার স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, এই তথ্য জনসমক্ষে আনা “জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী” হতে পারে। ফলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মৃত্যু নিয়েও কোনও বিস্তারিত তদন্তের তথ্য নেই।

লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর রহস্যজনক মৃত্যু ও সংশ্লিষ্ট সন্দেহজনক মৃত্যুসমূহ

লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যু কেবলমাত্র একটি ঐতিহাসিক ধোঁয়াশা নয় বরং এটি ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি অমীমাংসিত অধ্যায়। তাঁর আকস্মিক ও সন্দেহজনক মৃত্যু যেমন প্রশ্ন তোলে, তেমনি তাঁর মৃত্যুর পরবর্তী সময়ে যেসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা সন্দেহজনক পরিস্থিতিতে মারা যান, তাও এই রহস্যকে আরও গভীর ও উদ্বেগজনক করে তোলে।

১. ড. আর. এন. চুঘ (Dr. R. N. Chugh)

ড. চুঘ ছিলেন লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর পারিবারিক চিকিৎসক এবং তাঁর মৃত্যু-পরবর্তী তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী। তিনি ছিলেন একমাত্র ভারতীয় চিকিৎসক যিনি তাসখন্দ সফরের পর তাঁর মৃত্যু সংক্রান্ত চিকিৎসাগত তথ্য জানতেন।

শাস্ত্রীর মৃত্যুর কয়েক বছর পরে, ১৯৭৭ সালে, তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি তদন্তের আগে একটি “রোড অ্যাক্সিডেন্ট”-এ নিহত হন। সেই দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান এবং তাঁর স্ত্রী, পুত্র ও কন্যা গুরুতর আহত হন।
অনেকে মনে করেন, এটি ছিল পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড, যাতে তিনি কোনও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশ করতে না পারেন।

২. রামনাথ (শাস্ত্রীর ব্যক্তিগত রাঁধুনি)

শাস্ত্রীর মৃত্যুর রাতে শেষ খাবার রামনাথ তৈরি করেছিলেন। অনেকের দাবি, তাঁর সাক্ষ্য গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হতে পারত। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, তাঁকে কখনোই সংবাদমাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। এরপর রামনাথ অল্প সময়ের মধ্যেই নিখোঁজ হয়ে যান এবং পরে তাঁরও মৃত্যু ঘটে। এ ঘটনাও ছিল যথেষ্ট রহস্যজনক।

লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যু নিঃসন্দেহে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক রহস্যময় অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত। একজন সৎ ও নির্ভীক প্রধানমন্ত্রীর এমন হঠাৎ প্রয়াণ এবং সেই মৃত্যুকে ঘিরে এত অস্পষ্টতা আজও বহু মানুষের মনে প্রশ্নের উদ্রেক করে। যতদিন না তাঁর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ সামনে আসে, ততদিন এই রহস্য অমীমাংসিতই থেকে যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *