গান্ধীজি ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও মতের বৈচিত্র্যে গড়া সম্পর্ক

নয়াপ্রজন্ম প্রতিবেদনঃ

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে মহাত্মা গান্ধী এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দুটি আলাদা ধারার প্রতিনিধিত্ব করলেও তাঁদের মধ্যে ছিল গভীর পারস্পরিক শ্রদ্ধা, বন্ধুত্ব এবং আদর্শগত বিনিময়। এই দুই মহান ব্যক্তিত্বের সম্পর্ক ছিল কখনো সহমতের, কখনো মতবিরোধপূর্ণ; কিন্তু চিরকাল ছিল সৌহার্দ্যপূর্ণ ও গঠনমূলক।

প্রথম পরিচয় ও পারস্পরিক শ্রদ্ধা

১৯১৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিরে আসার পর গান্ধীজি ভারতের রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। প্রাথমিক পর্যায়েই তাঁর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিচয় ঘটে। ঠাকুর প্রথম থেকেই গান্ধীজির ত্যাগের আদর্শ ও নৈতিক অবস্থানের প্রশংসা করেন। তিনিই প্রথম গান্ধীজিকে “মহাত্মা” উপাধিতে ভূষিত করেন। অপরদিকে গান্ধীজি রবীন্দ্রনাথকে বলতেন “গুরুদেব”।

মতবিরোধ: আদর্শিক ভিন্নতা

যদিও তাঁরা একে অপরকে গভীর শ্রদ্ধা করতেন, তবুও বহু বিষয়ে তাঁদের মতবিরোধ ছিল। যেমন:

  • চরকা ও আত্মনির্ভরতা: গান্ধীজি চরকার মাধ্যমে গ্রামীণ শিল্পকে উজ্জীবিত করতে চেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ একে অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে করতেন। তাঁর মতে, শিল্প ও বিজ্ঞাননির্ভর শিক্ষা ছিল ভবিষ্যতের পথ।
  • নৈরাজ্য ও প্রতিবাদ: গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ পুরোপুরি সহমত ছিলেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন, ব্রিটিশদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে নয় বরং জ্ঞানের মাধ্যমে ভারতকে জাগ্রত করতে হবে।

জাতীয়তাবাদ ও মানবতাবাদ

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন বিশ্বমানবতাবাদী। তিনি সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করতেন না। অন্যদিকে গান্ধীজি ভারতের স্বাধীনতাকে জীবনের মূল ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তবুও, দুইজনেই একমত ছিলেন যে, সত্য, অহিংসা এবং নৈতিকতাই ভবিষ্যতের ভিত্তি।

শিক্ষা ও শান্তিনিকেতন

গান্ধীজি শান্তিনিকেতনে এসে ঠাকুরের শিক্ষাদর্শে মুগ্ধ হন। শান্তিনিকেতন তাঁর কাছে ছিল একটি আত্মিক আশ্রয়। তিনি সেখানে বহুবার গিয়েছেন ও রবীন্দ্রনাথের ছাত্রদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন।

শেষ পর্যন্ত পারস্পরিক শ্রদ্ধা অটুট ছিল

রবীন্দ্রনাথ একবার লিখেছিলেন:

–“মহাত্মাজির কাছে আমি তর্ক করতে পারি, কিন্তু তাঁকে ভালো না বেসে থাকতে পারি না।”–

অন্যদিকে গান্ধীজি রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর বলেছিলেন:

–“আমি অনুভব করি, ভারত আজ তার শ্রেষ্ঠ সন্তানকে হারাল।”–

গান্ধীজি ও রবীন্দ্রনাথ ছিলেন দুই ভিন্ন পথের পথিক, কিন্তু তাঁদের গন্তব্য ছিল এক—ভারতের মুক্তি ও মানুষের আত্মমর্যাদার প্রতিষ্ঠা। তাঁদের সম্পর্ক প্রমাণ করে, মতবিরোধ থাকা সত্ত্বেও আন্তরিকতা, শ্রদ্ধা ও দেশপ্রেম কীভাবে মানুষকে একত্রিত করতে পারে।

এই সম্পর্ক ইতিহাসে একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে—যেখানে ভিন্নমত বিভাজন নয়, বরং সমৃদ্ধির কারণ হয়ে ওঠে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *