নয়াপ্রজন্ম প্রতিবেদনঃ
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর—দুজনেই বাংলা ও ভারতের ইতিহাসে মহৎ দুই ব্যক্তিত্ব। একজন ছিলেন রাজনীতির ময়দানে অপ্রতিরোধ্য সংগ্রামী নেতা, অন্যজন কাব্যের রাজপথে অনন্য সাধক। যদিও তাদের জীবনধারা ও পেশা আলাদা ছিল, তবুও তাদের মধ্যে ছিল গভীর পারস্পরিক শ্রদ্ধা, আদর্শগত প্রভাব এবং ঐতিহাসিক সম্পর্ক।
রবীন্দ্রপ্রভাবিত নেতাজি
সুভাষচন্দ্র বসু যখন প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র, তখন থেকেই তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখনী ও দর্শনে প্রভাবিত হন। কবিগুরুর জাতীয়তাবাদী ভাবনা, মানবতাবাদ এবং সাংস্কৃতিক জাগরণ নেতাজির চিন্তাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। ১৯১৭ সালে, মাত্র বিশ বছর বয়সে, নেতাজি রবীন্দ্রনাথের “চিত্ত যেথা ভয়শূন্য…” কবিতাটি তাঁর আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন।
একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা
১৯৩০-এর দশকে, যখন সুভাষচন্দ্র ভারতীয় রাজনীতিতে দ্রুত উত্থান ঘটাচ্ছেন, রবীন্দ্রনাথ তখনও সক্রিয়ভাবে সাহিত্য ও সমাজ চিন্তায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন। নেতাজি কবিগুরুর কাছে একটি চিঠিতে লেখেন,
“আপনার লেখনী আমার জীবনের দিশারী, আপনি আমাদের জাতীয় চেতনার পুরোধা।”
অন্যদিকে, রবীন্দ্রনাথও নেতাজির সাহস ও আত্মত্যাগের প্রশংসা করেছিলেন। তিনি একাধিকবার সুভাষকে “অগ্নিযুবক” বলে অভিহিত করেন।
১৯৩০-এর দশকে সংকটকালীন সমর্থন
নেতাজি যখন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতির পদে আসেন (১৯৩৮), তখন কংগ্রেসের ভেতরে মতবিরোধ তীব্র হয়। গান্ধীজির বিপরীতে সুভাষচন্দ্রের অবস্থান অনেকের কাছে বিতর্কিত হলেও, রবীন্দ্রনাথ তাঁর সাহসী পদক্ষেপের প্রশংসা করেছিলেন। যদিও দু’জনের রাজনৈতিক কৌশল পৃথক, তবুও দেশমাতৃকার মুক্তির লক্ষ্যে উভয়ের উদ্দেশ্য ছিল এক।
শেষের দিকে সম্পর্ক
১৯৪১ সালে দেশ ছাড়ার আগে সুভাষচন্দ্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “জন গণ মন” গানটিকে আজাদ হিন্দ ফৌজের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে স্থান দেন। কবিগুরু সেই সময়ে প্রয়াত হলেও তাঁর সৃষ্টিতে নেতাজির মনজগতে অব্যাহত প্রভাব রয়ে যায়। স্বাধীন ভারতের গানে, কবিগুরুর “জন গণ মন” আর নেতাজির “বন্দে মাতরম” ছিল আত্মত্যাগ ও ঐক্যের দুই প্রতীক।
নেতাজি ও রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ছিল একটি মননশীল যুগলবন্দি—যেখানে একদিকে ছিল সাহিত্যের শক্তি, অন্যদিকে ছিল সংগ্রামের দৃঢ়তা। তাঁদের এই পারস্পরিক শ্রদ্ধা, আদর্শের বিনিময় এবং স্বাধীনতার লক্ষ্যে একাত্মতা আজও প্রেরণার উৎস। দুই মহামানবের এই সম্পর্ক ইতিহাসে এক অসামান্য অধ্যায় হয়ে রয়ে গেছে।
