নয়াপ্রজন্ম প্রতিবেদনঃ
ভারতের প্রাচীন ইতিহাস ও পৌরাণিক সাহিত্যে সরস্বতী নদীর নাম বারবার উচ্চারিত হয়েছে। ঋগ্বেদে এই নদীকে নদীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠা বলা হয়েছে। হাজার হাজার বছর আগে এই নদী গুম হয়ে গিয়েছিল, তবে সাম্প্রতিক ভূগোল, উপগ্রহ চিত্র এবং পুরাতাত্ত্বিক গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে যে সরস্বতী নদীর কিছু অংশ এখনো ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে দৃশ্যমান।

মানচিত্রে সরস্বতী নদীর পথ চিত্রিত করা হয়েছে।
মানা গ্রাম – সরস্বতীর প্রাকৃতিক জন্মস্থান
উত্তরাখণ্ড রাজ্যের চামোলি জেলার মানা গ্রাম হিমালয়ের কোলে অবস্থিত একটি অত্যন্ত পবিত্র স্থান, যা ভারতের শেষ গ্রাম হিসেবে পরিচিত। এখানেই রয়েছে সরস্বতী নদীর দৃশ্যমান উৎস। ভগীরথী ও আলকানন্দার মতো হিমালয়ী নদীগুলোর মাঝে এই সরস্বতী নদী ছোট হলেও গুরুত্বপূর্ণ।
সরস্বতী নদীর প্রাকৃতিক উৎস মানা গ্রামে একটি গুহা থেকে উদ্ভূত হয়েছে, যাকে সরস্বতী উৎস বলা হয়। এটি ভগবতপুরাণ ও মহাভারতের নানা অধ্যায়ে উল্লেখিত সরস্বতী নদীর সঙ্গে মিল খুঁজে পায়। এখানেই রয়েছে ভীমপুল, একটি প্রাকৃতিক পাথরের সেতু, যেটি ভীম তার স্ত্রীর জন্য গড়ে তুলেছিল বলে জনশ্রুতি।
মানা গ্রামে সরস্বতী নদীর প্রবাহ এখনো দৃশ্যমান — প্রবল স্রোতে পাহাড় কাঁপানো আওয়াজে সে জানান দেয় তার অস্তিত্ব। পরে এই নদী কিছুদূর গিয়ে ভূগর্ভে মিলিয়ে যায়, যাকে অনেকেই “অদৃশ্য সরস্বতী” হিসেবে অভিহিত করেন।

ভীম দুইটি পাথর জোড়া লাগিয়ে সেতু তৈরি করলেন, যাতে তাঁর স্ত্রী দ্রৌপদী পার হতে পারেন।
পৌরাণিক ইতিহাস ও আধুনিক বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান
সরস্বতী নদীকে ঘিরে রয়েছে পৌরাণিক, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব। প্রাচীন হরপ্পা সভ্যতার একাধিক কেন্দ্র এই নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল। পরবর্তীকালে ভূমিকম্প, জলবায়ু পরিবর্তন ও নদীর পথ পরিবর্তনের কারণে সরস্বতী হারিয়ে যায়।
আধুনিক ভূতত্ত্ববিদ, বিশেষত ইসরো (ISRO) এবং ভূতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগ (GSI), স্যাটেলাইট চিত্র ও ভূগর্ভস্থ জলপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে হরিয়ানা, পাঞ্জাব, রাজস্থান ও গুজরাটে সরস্বতীর প্রাচীন ধারা পুনরুদ্ধার করেছেন।
আধুনিক উদ্যোগ ও সরস্বতী হেরিটেজ প্রজেক্ট
হরিয়ানার আদিবাদরি অঞ্চলকে সরস্বতী নদীর পুনরুজ্জীবনের কেন্দ্র করে দেখা হচ্ছে। এখানে একটি সরস্বতী হেরিটেজ প্রজেক্ট গড়ে তোলা হয়েছে। এছাড়া মাতিলা, সিরসা, বিকানের অঞ্চলেও নদীর চিহ্ন এবং ভূগর্ভস্থ প্রবাহ আবিষ্কৃত হয়েছে।
সরকারি উদ্যোগে নদীর পথ ধরে পুকুর খনন, জল সংরক্ষণ এবং ধর্মীয় পর্যটনের সুযোগ তৈরি করা হচ্ছে। এই প্রকল্পে মানা গ্রামের ঐতিহাসিক গুরুত্বকেও সমানভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
মানা গ্রামে আজও যেখানে সরস্বতী নদীর ধারা গর্জে ওঠে, সেখানে দাঁড়িয়ে আমরা প্রাচীন ভারতের প্রাণবন্ত ইতিহাসকে অনুভব করতে পারি। এই নদী কেবলমাত্র ধর্মীয় বা পৌরাণিক নয়, এটি ভারতীয় সভ্যতার স্পন্দন ছিল। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাহায্যে যদি সরস্বতী নদীর প্রাচীন ধারা পুনরুজ্জীবিত হয়, তবে তা আমাদের সংস্কৃতিকে নতুন আলোয় উদ্ভাসিত করবে।