অঙ্কোর ভাট মন্দির: কাব্যিক স্থাপত্যে এক ইতিহাসের নিদর্শন

নয়াপ্রজন্ম প্রতিবেদনঃ

অঙ্কোর ভাট (Angkor Wat), পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম ধর্মীয় স্থাপত্য, কেবলমাত্র একটি মন্দিরই নয়—এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও স্থাপত্যশিল্পের এক চূড়ান্ত নিদর্শন। বর্তমান ক্যাম্বোডিয়ার সিয়েম রিয়াপ প্রদেশে অবস্থিত এই মন্দিরটি কেবল ক্যাম্বোডিয়ার জাতীয় গর্বই নয়, এটি দেশটির জাতীয় পতাকার মধ্যেও স্থান পেয়েছে।

ইতিহাসের ছায়ায় জন্ম

অঙ্কোর ভাট নির্মিত হয় ১২শ শতকে, খেমার সাম্রাজ্যের রাজা সূর্যবর্মন দ্বিতীয়-এর শাসনকালে (১১১৩–১১৫০ খ্রিঃ)। শুরুতে এটি হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে নির্মিত একটি মন্দির ছিল। তবে পরবর্তীকালে ১৪শ শতক থেকে এটি ধীরে ধীরে একটি বৌদ্ধ মন্দিরে রূপান্তরিত হয়। এই ধর্মীয় রূপান্তর মন্দিরের ভাস্কর্য, প্রতিমা এবং শিল্পশৈলীতেও প্রতিফলিত হয়েছে।

স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন

অঙ্কোর ভাট মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী ক্লাসিক্যাল খেমার আর্কিটেকচারের চূড়ান্ত নিদর্শন। পুরো কমপ্লেক্সটি প্রায় ৪০০ একর জমির উপর বিস্তৃত, যার কেন্দ্রে রয়েছে পাঁচটি প্রধান মিনার—মধ্যবর্তী একটি প্রধান মিনারকে ঘিরে চারটি উপমিনার। এই গঠনশৈলী হিন্দু মহাবিশ্বের কেন্দ্র মেরু পর্বতের প্রতীক।

মন্দিরটি পশ্চিমমুখী, যা বিরল; বেশিরভাগ হিন্দু মন্দির পূর্বমুখী হয়। অনেক গবেষক মনে করেন, এই পশ্চিমমুখিতা বিষ্ণুর সাথে সম্পর্কিত কারণ তিনি পশ্চিম দিকের অধিপতি হিসেবে বিবেচিত।

শিল্প ও ভাস্কর্যের অপূর্ব সমাহার

অঙ্কোর ভাট-এর ভাস্কর্য এবং রিলিফ খোদাই গুলিকে প্রাচীন শিল্পশৈলীর এক শ্রেষ্ঠ নিদর্শন বলা হয়। মন্দিরের গায়ে খোদাই করা হয়েছে রামায়ণ এবং মহাভারত-এর বিভিন্ন কাহিনি, দানব ও দেবতা, দেবদাসী নৃত্য এবং রাজকীয় সভার দৃশ্য। এই খোদাইগুলি এতটাই সূক্ষ্ম ও জীবন্ত যে মনে হয় যেন পাথরে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব

যদিও এটি শুরুতে হিন্দু মন্দির ছিল, আজ এটি একটি সক্রিয় বৌদ্ধ উপাসনাস্থল। ক্যাম্বোডিয়ার মানুষদের কাছে অঙ্কোর ভাট শুধুই একটি প্রাচীন স্থাপত্য নয়—এটি তাদের আত্মপরিচয়ের প্রতীক। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ পর্যটক ও তীর্থযাত্রী এখানে আসেন মনের শান্তি এবং ইতিহাসের ছোঁয়া পেতে।

বিশ্ব ঐতিহ্যের মর্যাদা

১৯৯২ সালে ইউনেস্কো অঙ্কোর ভাটকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ঘোষণা করে। এর ফলে আন্তর্জাতিকভাবে এই মন্দিরের সংরক্ষণ এবং পুনরুদ্ধার কার্যক্রম শুরু হয়। আজ এটি বিশ্বব্যাপী পর্যটকদের জন্য একটি অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান।

অঙ্কোর ভাট মন্দির কেবল একটি ধর্মীয় বা ঐতিহাসিক স্থাপত্য নয়—এটি হাজার বছরের এক সভ্যতার, এক কল্পনার, এক বিস্ময়কর নির্মাণশৈলীর প্রতীক। এ যেন পাথরের উপর খোদাই করা এক জীবন্ত ইতিহাস, যা যুগ যুগ ধরে বিশ্ববাসীকে মুগ্ধ করে চলেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *