নয়াপ্রজন্ম প্রতিবেদনঃ
ভারতের প্রাচীনতম শহর বারাণসী, যাকে বলা হয় “মোক্ষের দ্বার”, সেই বারাণসীর হৃদয়ে অবস্থিত এক রহস্যময় ও মহাপবিত্র স্থান হল মণিকর্ণিকা মন্দির ও ঘাট। হিন্দু ধর্মে বিশ্বাস করা হয়, এখানে মৃত্যু মানেই মোক্ষ বা চিরমুক্তি। এই স্থান শুধু একটি শ্মশান ঘাট নয়, বরং জীবনের অন্তিম সত্য ও আত্মার চিরশান্তির প্রতীক।
নামের উৎস ও পৌরাণিক কাহিনি
“মণিকর্ণিকা” নামটি দুটি শব্দ থেকে এসেছে— “মণি” অর্থাৎ রত্ন এবং “কর্ণিকা” অর্থাৎ কানের অলংকার।
স্কন্দ পুরাণ ও অন্যান্য হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী, একসময় ভগবান বিষ্ণু বহু যুগ ধরে বারাণসীতে তপস্যা করেন এবং তাঁর এই তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে ভগবান শিব তাঁকে দর্শন দেন। তখন বিষ্ণু নিজের চক্র দিয়ে একটি কুণ্ড খনন করেন— যেটি আজকের “মণিকর্ণিকা কুণ্ড” নামে পরিচিত।
এই সময় দেবী পার্বতীর কানের রত্ন (মণিকর্ণিকা) সেই কুণ্ডে পড়ে যায়, আর সেখান থেকেই এই স্থানের নাম “মণিকর্ণিকা” হয়।
আরেক কাহিনিতে বলা হয়, দেবী অন্নপূর্ণা ও ভগবান শিব এখানে একত্রে এসেছিলেন এবং স্নান করেছিলেন। সেই পবিত্র স্মৃতিকে ঘিরেই আজ এই ঘাট ও মন্দির পূজিত হয়।
মৃত্যুর পর মোক্ষের পথ
মণিকর্ণিকা ঘাটকে হিন্দুদের কাছে মৃত্যু-পরবর্তী মোক্ষ লাভের জন্য সবচেয়ে পবিত্র স্থান বলে মনে করা হয়। এই ঘাটে প্রতিদিন শত শত মৃতদেহ দাহ করা হয়, কারণ বিশ্বাস করা হয় যে, বারাণসীতে মৃত্যু হলে এবং মণিকর্ণিকায় দাহ হলে আত্মা আর পুনর্জন্মে আবদ্ধ থাকে না—সে চিরমুক্তি লাভ করে।
এমনকি বলা হয়, ভগবান শিব স্বয়ং মৃতের কানে “রাম নাম” ফিসফিস করে বলেন, যার মাধ্যমে আত্মা মোক্ষের পথে অগ্রসর হয়।
এই কারণে বহু মানুষ বার্ধক্যে বারাণসীতে এসে শেষ জীবন অতিবাহিত করতে চান, যাতে মৃত্যু হলে তাঁকে এই ঘাটেই দাহ করা যায়।

মণিকর্ণিকা মন্দিরের স্থাপত্য ও পরিবেশ
মণিকর্ণিকা মন্দির খুব জাঁকজমকপূর্ণ নয়, বরং একটি সরল ও পুরনো কাঠামোর মধ্যে শিবলিঙ্গ পূজিত হয়। এটি মণিকর্ণিকা কুণ্ডের পাশে অবস্থিত।
চতুর্দিকে চিতা-দাহের ধোঁয়া, ভক্তদের মন্ত্রোচ্চারণ, গঙ্গার প্রবাহ এবং আধ্যাত্মিক পরিবেশ মিলে একটি গভীর, ভাবগম্ভীর আবহ সৃষ্টি করে।
এই ঘাটের একটি বিশেষত্ব হলো— এখানে চিতার আগুন কখনো নিভে না। দিনের ২৪ ঘণ্টা, বছরের ৩৬৫ দিনই এখানে দাহকার্য চলে। এটি “অক্ষয় চিতা” নামে পরিচিত।

কলিযুগের শেষের ভবিষ্যদ্বাণী
মণিকর্ণিকা মন্দির সম্পর্কে একটি রহস্যময় লোকবিশ্বাস প্রচলিত আছে—
যেদিন এই মন্দির সম্পূর্ণভাবে গঙ্গার জলে ডুবে যাবে, সেদিনই কলিযুগের সমাপ্তি হবে।
এই ভবিষ্যদ্বাণী বহু ভক্ত ও আধ্যাত্মিক সাধকের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করে রেখেছে। অনেকে বলেন, এই মন্দিরের অস্তিত্ব টিকে থাকা মানেই কলিযুগ এখনো চলছে, আর যেদিন তা থাকবে না, সেদিন শুরু হবে এক নতুন যুগ।

ধর্মীয় মাহাত্ম্য ও অনুষ্ঠান
- মহাশিবরাত্রি, গঙ্গাস্নান উৎসব, এবং পিতৃপক্ষ উপলক্ষে এই ঘাট ও মন্দিরে বিপুল সংখ্যক ভক্ত সমাগম হয়।
- বহু সাধু ও সন্ন্যাসী এখানে সাধনা করে থাকেন।
- বারাণসীতে আসা অনেক পর্যটকও মণিকর্ণিকা ঘাটের আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব অনুভব করতে এই জায়গায় আসেন।
দর্শনার্থীদের জন্য তথ্য:
- মণিকর্ণিকা ঘাটে পৌঁছাতে বারাণসীর সরু গলি ও বাজার পেরিয়ে আসতে হয়।
- এখানে ছবি তোলা বা ভিডিও করা একরকম নিষিদ্ধ, কারণ এটি একটি পবিত্র ও সংবেদনশীল স্থান।
- স্থানীয় গাইডদের সাহায্যে ঘাটের ইতিহাস ও পৌরাণিকতা সম্পর্কে জানা যায়।
মণিকর্ণিকা মন্দির ও ঘাট শুধুমাত্র এক ধর্মীয় স্থান নয়, এটি জীবনের অন্তিম পথযাত্রার এক আধ্যাত্মিক নির্দেশক। এখানে মৃত্যু মানে শুধুই সমাপ্তি নয়, বরং চিরশান্তির শুরু। শ্মশানের অগ্নি ও গঙ্গার স্রোতের মাঝে, জীবনের নশ্বরতা ও আত্মার অমরত্ব একসাথে মিলেমিশে যায়।
এই মন্দির ও ঘাট আমাদের মনে করিয়ে দেয়—
“যেখানে মৃত্যু পবিত্র, সেখানে জীবনও পূর্ণতা লাভ করে।”