নয়াপ্রজন্ম প্রতিবেদনঃ
দাবা, বুদ্ধির যুদ্ধ নামেও পরিচিত, বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রাচীন স্ট্র্যাটেজিক গেমগুলোর একটি। আজকের দিনে এটি শুধু একটি খেলা নয়—একটি শিল্প, একটি বিজ্ঞান এবং মানসিক দক্ষতার এক অসাধারণ প্রতীক। কিন্তু এই মস্তিষ্কপ্রসূত খেলাটির সূচনা কোথায়? চলুন জেনে নিই দাবা খেলার জন্ম ও বিবর্তনের ইতিহাস।
গুপ্ত রাজবংশ ও দাবার সূচনা
দাবা খেলার আদিরূপ চতুরঙ্গ যে ভারতে উদ্ভূত হয়েছিল, তার সময়কাল ঐতিহাসিকভাবে ধরা হয় গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময় (প্রায় ৩২০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৫৫০ খ্রিস্টাব্দ)। এই যুগকে বলা হয় “ভারতের স্বর্ণযুগ”, কারণ এই সময় বিজ্ঞান, গণিত, সাহিত্য ও ক্রীড়াক্ষেত্রে অসাধারণ অগ্রগতি হয়েছিল।
গুপ্ত যুগে রাজসভাগুলোতে চতুরঙ্গ অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল এবং শিক্ষিত অভিজাত সমাজের মধ্যে এটি একটি জ্ঞানের খেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজপুত্রদের মধ্যে সামরিক কৌশল, ধৈর্য ও দূরদর্শিতা বৃদ্ধির জন্য এই খেলা ব্যবহার করা হতো। চতুরঙ্গের চারটি অংশ (পদাতিক, ঘোড়সওয়ার, রথ ও গজ) আসলে সেই সময়ের সেনাবাহিনীর বাস্তব কাঠামোর প্রতিফলন।
এই সময়ে তৈরি সাহিত্য, যেমন সুবন্ধু ও বাণভট্ট-এর লেখায় চতুরঙ্গের উল্লেখ পাওয়া যায়, যা দাবার প্রাচীনতা ও ভারতীয় শিকড়কে স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে।
চতুরঙ্গ থেকে শত্রঞ্জ
গুপ্ত যুগে জন্ম নেওয়া চতুরঙ্গ পরবর্তী সময়ে ছড়িয়ে পড়ে পারস্যে (আজকের ইরান)। পারস্যে এটি পরিচিত হয় “শত্রঞ্জ” নামে। এখানেই প্রথম “শাহ” (রাজা) ও “মাত” (শেষ) শব্দদ্বয়ের ব্যবহার হয়, যা পরবর্তীতে ইংরেজি “Checkmate”-এর উৎস।
আরব বিশ্ব ও ইউরোপে বিস্তার
৭ম শতকে মুসলিম আরবদের মাধ্যমে শত্রঞ্জ ছড়িয়ে পড়ে পুরো মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে। স্পেন ও ইতালি হয়ে এটি প্রবেশ করে ইউরোপীয় সভ্যতায় এবং মধ্যযুগে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
ইউরোপে এসে খেলাটির নিয়মে বড়সড় পরিবর্তন আসে। রানী ও বিশপ-এর গতি বাড়ানো হয় এবং ১৫শ শতকের মধ্যে দাবা হয়ে ওঠে আরও গতিশীল ও কৌশলনির্ভর।
আধুনিক যুগের সূচনা
১৮৮৬ সালে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম বিশ্ব দাবা চ্যাম্পিয়নশিপ, যা দাবার ইতিহাসে একটি মাইলফলক। এরপর দাবা বিশ্বব্যাপী সংগঠিত খেলায় পরিণত হয় এবং ১৯২৪ সালে গঠিত হয় আন্তর্জাতিক দাবা সংস্থা FIDE।
ভারতের গর্ব: বিশ্বনাথন আনন্দ ও গুকেশ ডি
ভারতের দাবা ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা করেন বিশ্বনাথন আনন্দ, যিনি ২০০০ সালে বিশ্বের প্রথম ভারতীয় বিশ্ব দাবা চ্যাম্পিয়ন হন। তার অসাধারণ সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে ভারতজুড়ে দাবা খেলায় বিপ্লব ঘটে।

আর সেই পথেই উঠে আসে আরেক বিস্ময়—গুকেশ ডি। মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি ২০২৪ সালে FIDE ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্ট জিতে বিশ্ব দাবা চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেন এবং বিশ্ব দাবা চ্যাম্পিয়ন হন।

এই কৃতিত্বের মাধ্যমে তিনি শুধু ভারতের নয়, গোটা বিশ্বের দাবা ইতিহাসে একটি মাইলফলক স্থাপন করেন। তিনি হলেন বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ দাবা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, এবং ভারতের দ্বিতীয় বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, বিশ্বনাথন আনন্দের পরে।
দাবা শুধু একটি খেলা নয়—এটি ধৈর্য, কৌশল, ও দূরদর্শিতার এক নিখুঁত পরীক্ষা। প্রাচীন ভারতের গুপ্ত যুগে জন্ম নেওয়া চতুরঙ্গ আজ বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের প্রিয় দাবা খেলায় রূপ নিয়েছে। বিশ্বনাথন আনন্দ যেভাবে ভারতের জন্য প্রথম জয় এনেছিলেন, এখন সেই ধারা আরও গৌরবময় করলেন ২০২৪ সালের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন গুকেশ ডি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দাবার রূপ বদলেছে, কিন্তু এর মূল চেতনা—বুদ্ধির যুদ্ধ—আজও অটুট।