মেঘালয়ের মাতৃতান্ত্রিক বিবাহ প্রথা: এক অনন্য ঐতিহ্যের প্রতিচ্ছবি

নয়াপ্রজন্ম প্রতিবেদনঃ

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত মেঘালয় শুধু তার অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেই নয়, বরং তার বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি ও সমাজব্যবস্থার জন্যও বিশেষভাবে পরিচিত। এখানকার বিবাহ প্রথাও তেমনই এক অনন্য সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি। মেঘালয় মূলত খাসি, গারো ও জৈন্তিয়া এই তিনটি প্রধান উপজাতির বাসস্থান। প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর বিবাহপ্রথা আলাদা হলেও, তাদের সবকটির মধ্যেই দেখা যায় মাতৃতান্ত্রিক সমাজের প্রভাব, যা ভারতের অন্য অংশের তুলনায় অনেকটাই ব্যতিক্রমী।

মেঘালয়ের খাসি ও গারো উপজাতিদের বিবাহপ্রথা মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার প্রতিফলন। এখানে নারীদের হাত ধরেই বংশপরম্পরা, সম্পত্তি ও সংস্কারের ধারাবাহিকতা বজায় থাকে।। বিবাহের পর বর কনের বাড়িতে বসবাস করেন এবং সন্তান মায়ের গোত্র গ্রহণ করে। পরিবারের সম্পত্তি সাধারণত কনিষ্ঠ কন্যার কাছে যায়। কন্যাসন্তানের জন্মকে আনন্দের সঙ্গে উদ্‌যাপন করা হয়।

বিবাহে বর কনেকে কিছু পোশাক ও গয়না উপহার দেন, যা তার শ্রদ্ধা ও প্রতিশ্রুতির প্রতীক। কনে একটি সোনার বা রূপার মুকুট পরে, যা তার মর্যাদা বোঝায়। একই গোত্রে বিবাহ নিষিদ্ধ, এই নিয়ম ভাঙলে সমাজচ্যুতি পর্যন্ত হতে পারে। মাতুল (মায়ের ভাই) বিবাহ আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

বিবাহবিচ্ছেদ এখানে বিরল হলেও অনুমোদিত, বিশেষ করে নিঃসন্তান দম্পতির ক্ষেত্রে। বিবাহবিচ্ছেদের সময় সেই একই সাক্ষীরা উপস্থিত থাকেন যারা বিবাহের সময় ছিলেন। বিবাহবিচ্ছেদ ছাড়া পুনর্বিবাহ করা যায় না।

এই প্রথাগুলি নারীদের সম্মান ও সমাজে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে তুলে ধরে, যেখানে বিবাহ শুধু দুটি ব্যক্তির নয়, বরং দুটি পরিবারের, এমনকি গোত্রের সংযুক্তি।

খাসি সম্প্রদায়ের বিবাহ

খাসি জনগোষ্ঠীর সমাজব্যবস্থা মাতৃতান্ত্রিক। অর্থাৎ, সম্পত্তির অধিকার, পারিবারিক পরিচয় ও উত্তরাধিকার সবই নারীর মাধ্যমে নির্ধারিত হয়।

বিবাহপ্রথা:
খাসি বিবাহে পুরুষ পক্ষ কনে পক্ষকে প্রস্তাব পাঠায়। দু’পক্ষের সম্মতিতে এক অনাড়ম্বর অথচ আবেগঘন অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। বিবাহের দিনে কনে ও বর ঐতিহ্যবাহী পোশাকে সজ্জিত থাকেন। তারা পরিবারের আশীর্বাদ গ্রহণ করেন এবং সমাজের প্রবীণরা তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য শুভকামনা জানান। খাসি বিবাহে ধর্মীয় আচার তুলনামূলকভাবে কম।

বিশেষত্ব:
খাসি বিবাহের পর বর কনের বাড়িতে এসে বসবাস করেন, যা ভারতের প্রথাগত পিতৃতান্ত্রিক সমাজে এক বিরল দৃষ্টান্ত।

গারো সম্প্রদায়ের বিবাহ

গারোরা মোটেও খাসিদের মতো নয়, তবে এখানেও সমাজ মাতৃতান্ত্রিক।

বিবাহপ্রথা:
গারো বিবাহে কনের পরিবার পাত্র বেছে নেয়। গারো নারীরা অত্যন্ত স্বাধীন এবং তাদের মতামতের ভিত্তিতে বিবাহ সম্পন্ন হয়। বিবাহ অনুষ্ঠান সাদামাটা হলেও উৎসবের আমেজে পরিপূর্ণ।

বিশেষত্ব:
গারো সমাজে, বিবাহের পরে বর কনের পরিবারের অংশ হয়ে যান এবং সম্পত্তির অধিকারও নারীর মধ্য দিয়ে চলে।

জৈন্তিয়া সম্প্রদায়ের বিবাহ

জৈন্তিয়া সমাজেও মাতৃতান্ত্রিক প্রভাব সুস্পষ্ট।

বিবাহপ্রথা:
এখানে বিবাহের আগে একাধিক সামাজিক প্রথা মানা হয়। “Ka khut shong kur” নামে একটি বিশেষ অনুষ্ঠান হয় যেখানে বর-কনে উভয় পরিবার সামাজিকভাবে একত্রিত হন।

বিশেষত্ব:
বিবাহ সম্পন্ন হওয়ার পর কনে তার মায়ের পরিবারের অংশে থাকেন এবং বর সেখানে বসবাস শুরু করেন।

বিবাহে সঙ্গীত ও নৃত্য

মেঘালয়ের বিবাহ মানেই হল আনন্দ, সঙ্গীত এবং নৃত্যের এক উত্সব। খাসি ও গারো উভয় জাতির বিবাহ অনুষ্ঠানে স্থানীয় বাদ্যযন্ত্রের সুরে ঐতিহ্যবাহী নৃত্য পরিবেশিত হয়, যা এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে আরও সমৃদ্ধ করে।

আধুনিক প্রভাব ও পরিবর্তন

যদিও ঐতিহ্যবাহী প্রথাগুলি এখনো প্রচলিত, তবুও আধুনিক শিক্ষার প্রসার এবং সামাজিক যোগাযোগের বৃদ্ধির ফলে মেঘালয়ের বিবাহ প্রথাতেও কিছু পরিবর্তন এসেছে। এখন অনেক দম্পতিই রেজিস্ট্রি ম্যারেজ ও খ্রিস্টান ধর্মীয় আচার অনুসরণ করেন।

মেঘালয়ের বিবাহ প্রথা কেবল দুটি মানুষের মধ্যে নয়, দুটি পরিবারের সংযুক্তি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক অমূল্য নিদর্শন। মাতৃতান্ত্রিক সমাজের এই অপূর্ব বিবাহ প্রথা আজও আমাদের মনে করিয়ে দেয়, যে সমাজে নারীর সম্মান ও মর্যাদা অটুট থাকে, সেখানে ভালোবাসা ও সম্পর্কের বন্ধন আরও গভীর হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *