আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু ও বিতর্কের ইতিহাস

নয়াপ্রজন্ম প্রতিবেদনঃ

আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী। তিনি পদার্থবিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান ও রেডিও বিজ্ঞানে অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন। তবে, তাঁর জীবন ও গবেষণা নিয়ে একাধিক বিতর্কও ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। এই নিবন্ধে আমরা আচার্য বসুর জীবনের সেই বিতর্কিত অধ্যায়গুলি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব।

রেডিও আবিষ্কার ও মারকোনি বিতর্ক

আচার্য বসুর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গবেষণা ছিল রেডিও তরঙ্গের ব্যবহার নিয়ে। ১৮৯৫ সালে, মারকোনির আগে তিনি রেডিও মাইক্রোওয়েভ (radio microwaves) ব্যবহার করে তারবিহীন বার্তা প্রেরণ সফলভাবে সম্পন্ন করেছিলেন। তিনি একটি ঘণ্টা বাজিয়ে ও একটি বিস্ফোরণ ঘটিয়ে প্রমাণ করেছিলেন যে, রেডিও তরঙ্গ বাতাসের মধ্য দিয়ে ছড়াতে পারে।

তবে সমস্যা হয় এইখানেই। বসু তাঁর কাজের পেটেন্ট করাননি। তিনি বিশ্বাস করতেন জ্ঞান সবের জন্য। তাঁর এই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির সুযোগ নেন ইতালীয় বিজ্ঞানী গুগলিয়েলমো মারকোনি, যিনি পরে ১৯০১ সালে আটলান্টিক মহাসাগর পেরিয়ে বার্তা পাঠিয়ে বিখ্যাত হন এবং ১৯০৯ সালে নোবেল পুরস্কার পান। বসুর গবেষণা সত্ত্বেও, তিনিই ইতিহাসে প্রথম রেডিও উদ্ভাবক হিসেবে স্বীকৃতি পান।

এ নিয়ে বহু বিজ্ঞানী ও ঐতিহাসিক আজও দাবি করেন যে, “রেডিওর আসল জনক” ছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু, কিন্তু তাঁকে উপযুক্ত স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। এই বিতর্ক আজও বহমান।

উদ্ভিদের প্রাণ নিয়ে বিতর্ক

বসুর আরেকটি যুগান্তকারী গবেষণা ছিল উদ্ভিদের সাড়া দেওয়ার ক্ষমতা নিয়ে। তিনি ক্রেসকোগ্রাফ যন্ত্র আবিষ্কার করেন, যা উদ্ভিদের নাড়িচালনাকে পরিমাপ করতে পারত। তিনি দেখান, উদ্ভিদও ব্যথা, আনন্দ, চাপ, আলো ও শব্দে প্রতিক্রিয়া জানায়।

এই গবেষণা অনেক পাশ্চাত্য বিজ্ঞানীর কাছে তখন অদ্ভুত ও “ছদ্মবিজ্ঞান” বলে মনে হয়েছিল। তাঁদের বক্তব্য ছিল, উদ্ভিদের মধ্যে প্রাণ নেই বলে তাদের “স্নায়বিক প্রতিক্রিয়া” হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু বসুর পরীক্ষাগুলি পরবর্তীকালে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে এবং আধুনিক উদ্ভিদ-জীববিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপন করেছে।

ব্রিটিশ বৈজ্ঞানিক সমাজে বর্ণবৈষম্য ও স্বীকৃতির অভাব

আরও একটি বিতর্কের উৎস ছিল ব্রিটিশ বৈজ্ঞানিক সমাজে বসুর প্রতি আচরণ। তিনি যখন রয়্যাল সোসাইটিতে গবেষণা পেশ করেন, তখন তাঁর কাজ খাটো করে দেখা হয়। অনেক ব্রিটিশ বিজ্ঞানী তাঁর কাজের গুরুত্ব বুঝতে চায়নি শুধুমাত্র তাঁর জাতিগত পরিচয়ের কারণে। এমনকি ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের সদস্যরাও তাঁর গবেষণার জন্য যথাযথ সরকারি অর্থ বরাদ্দ করতে দ্বিধান্বিত ছিলেন।

পেটেন্ট নিয়ে মতাদর্শিক দ্বন্দ্ব

আচার্য বসু পেটেন্ট করাকে অপ্রয়োজনীয় মনে করতেন। তিনি বারবার বলেছিলেন,

জ্ঞান কখনও ব্যক্তিগত সম্পত্তি হতে পারে না।”
এই মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি, যদিও মহান, কিন্তু পরবর্তীতে অনেক ভারতীয় বিজ্ঞানী মনে করেন যে, এর ফলে বসু নিজেই তাঁর ন্যায্য স্বীকৃতি হারিয়েছেন।

আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু ছিলেন একজন বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও মানবতাবাদী। কিন্তু তাঁর জীবন কেবল গৌরবের নয়, ছিল অবমূল্যায়ন ও বিতর্কের ইতিহাসও। রেডিও আবিষ্কার, উদ্ভিদের প্রতিক্রিয়া নিয়ে গবেষণা ও পশ্চিমা সমাজে বিজ্ঞানচর্চায় ভারতীয়দের জন্য অসুবিধার যে চিত্র তাঁর জীবনে উঠে আসে, তা আজও আমাদের ভাবতে বাধ্য করে।

তাঁর কাজের প্রতি পূর্ণ স্বীকৃতি দিতে হলে আমাদের দরকার এক নিরপেক্ষ ও তথ্যভিত্তিক মূল্যায়ন – যাতে ভবিষ্যতের বিজ্ঞানীরা জানেন, কোন পথ ধরে তাঁরা আজকের জ্ঞানের আলোয় পৌঁছেছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *