নয়াপ্রজন্ম প্রতিবেদনঃ
বিশ্বের ইতিহাসে এমন কিছু রত্ন রয়েছে, যেগুলি শুধু দামী নয়, বরং রহস্য, অভিশাপ, রক্তপাত এবং ক্ষমতার প্রতীক। সেরকমই এক কিংবদন্তিসম হীরার নাম ‘কোহিনূর’। যার নামের অর্থই হল ‘আলোয় ভরা পর্বত’ বা ‘আলোকপাহাড়’। এটি শুধু একটি রত্ন নয়, একাধিক সাম্রাজ্য, যুদ্ধ এবং ইতিহাসের সাক্ষ্য বহনকারী এক অমূল্য সম্পদ।

কোহিনূরের উৎপত্তি ও প্রাচীন ইতিহাস:
কোহিনূরের সঠিক উৎস এখনও ইতিহাসবিদদের মধ্যে বিতর্কের বিষয়। তবে অধিকাংশ গবেষকের মতে, এটি ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের গোলকুন্ডা খনি থেকে প্রাপ্ত। এই হীরাটি সম্ভবত খ্রিস্টীয় দশম বা একাদশ শতকে খনন করা হয়। তখন এটি ছিল আরও বড় আকৃতির এবং নাম ছিল আলাদা ‘সামন্তক’ বা অন্য কোনো ঐতিহ্যবাহী নাম।
মুঘল আমল ও হীরার যাত্রা:
মুঘল সম্রাট বাবরের লেখা ‘বাবরনামা’-তেও কোহিনূরের উল্লেখ পাওয়া যায়। এটি মুঘলদের হাতে আসে মালওয়া বা গুজরাত আক্রমণের পর। পরবর্তীতে সম্রাট শাহজাহান এটিকে তার ময়ূর সিংহাসনের (Peacock Throne) অংশ করেন। সেই সময়ে এই হীরার কদর ছিল সীমাহীন।

নাদির শাহ ও কোহিনূরের বিদেশ যাত্রা:
১৭৩৯ সালে ইরানের শাসক নাদির শাহ ভারত আক্রমণ করে দিল্লি দখল করেন এবং সাথে নিয়ে যান বিপুল সম্পদ ও এই কোহিনূর হীরা। বলা হয়, হীরার ঝলক দেখে তিনিই একে নাম দেন “কোহ-ই-নূর”, যার ফারসি অর্থ “আলোয় ভরা পর্বত”।
ব্রিটিশদের হাতে কোহিনূর:
পরবর্তী সময়ে আফগান ও শিখদের মধ্যে হাতবদলের পর, এটি পৌঁছায় মহারাজা রঞ্জিত সিংহের কাছে। রঞ্জিত সিংহের মৃত্যুর পরে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৮৪৯ সালে পাঞ্জাব জয় করে এবং লাহোর চুক্তি অনুযায়ী কোহিনূর হীরাকে ব্রিটিশদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এরপর হীরাটি ইংল্যান্ডে নিয়ে গিয়ে উপহার হিসেবে ব্রিটেনের রানী ভিক্টোরিয়ার হাতে তুলে দেওয়া হয়।

কোহিনূর বর্তমানে কোথায়?
বর্তমানে কোহিনূর হীরাটি লন্ডনের টাওয়ার অফ লন্ডন-এ সংরক্ষিত। এটি রানী এলিজাবেথের মুকুটে বসানো হয়েছিল। যদিও ভারত, পাকিস্তান, ইরান এবং আফগানিস্তান—সব দেশের পক্ষ থেকেই এই হীরাকে ফেরত চাওয়ার দাবি করা হয়েছে, কিন্তু এখনো পর্যন্ত এটি ব্রিটিশ রাজপরিবারের সংগ্রহেই রয়ে গেছে।
কোহিনূরের অভিশপ্ত ইতিহাস ও কিংবদন্তি:
কোহিনূর হীরাকে ঘিরে বহু বছর ধরেই অভিশাপের ছায়া দেখা যায়। ইতিহাসে একাধিক পুরুষ শাসক এই হীরার অধিকার পাওয়ার পর হারিয়েছেন রাজ্য, প্রাণ বা সম্মান। বলা হয়, এই হীরাটি নারীদের জন্য সৌভাগ্যের প্রতীক হলেও, পুরুষদের জন্য তা হয়ে দাঁড়ায় ধ্বংস ও দুর্ভাগ্যের প্রতীক।
অভিশাপের কিছু উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্তঃ
- নাদির শাহ: কোহিনূর দখলের পরে ইরানে ফিরে তিনি নিহত হন ষড়যন্ত্রে।
- আহমদ শাহ দুররানী ও তার বংশধররা: হীরার মালিকানা পেয়েও রাজনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন।
- মহারাজা রঞ্জিত সিংহের পুত্র দুলীপ সিংহ: কোহিনূরের মালিক হলেও অল্প বয়সেই ব্রিটিশদের হাতে ক্ষমতা হারান এবং নির্বাসনে জীবন কাটান।
- ব্রিটিশ রাজ পরিবার: যদিও তারা প্রকাশ্যে কোহিনূরের অভিশাপে বিশ্বাস করে না, তথাপি এটি কোনও পুরুষ রাজা কখনও পরিধান করেননি। শুধু নারীরা – যেমন রানী ভিক্টোরিয়া, রানী মেরি, রানী এলিজাবেথ – এই হীরাকে ব্যবহার করেছেন। ব্রিটিশ রাজ পরিবারে অলিখিতভাবে একটি বিশ্বাস আছে যে, পুরুষরা এটি পরিধান করলে দুর্ভাগ্য নেমে আসতে পারে।
কোহিনূরের সঙ্গে জড়িত কিংবদন্তি অভিশাপ
“He who owns this diamond will own the world, but will also know all its misfortunes. Only God or a woman can wear it with impunity.”
(যে এই হীরার মালিক হবে, সে বিশ্ব জয় করবে, কিন্তু সঙ্গে নিয়ে আসবে সমস্ত দুর্ভাগ্যও। কেবল ঈশ্বর বা নারীই নির্ভয়ে এটি ধারণ করতে পারেন।)
কোহিনূর শুধুমাত্র একটি মূল্যবান পাথর নয়; এটি একটি জাতির ইতিহাস, বেদনা, সাম্রাজ্যবাদ এবং আত্মপরিচয়ের প্রতীক। ভারতসহ একাধিক দেশ আজও এর ন্যায্য দাবি জানিয়ে চলেছে। এই হীরার গল্প যেন এক অনন্ত যাত্রা, যেখানে রাজনীতি, যুদ্ধ, বিশ্বাসঘাতকতা এবং লোভ একে ঘিরে রেখেছে যুগের পর যুগ।