নয়াপ্রজন্ম প্রতিবেদনঃ
দক্ষিণ আফ্রিকা পৃথিবীর অন্যতম সেরা সোনার খনি সমৃদ্ধ দেশ। ১৯ শতকের শেষভাগে যে সোনার খনিগুলির আবিষ্কার হয়েছিল, তা বিশ্ব অর্থনীতিতে বিপুল প্রভাব ফেলেছিল। এই খনিগুলিই এক সময় দক্ষিণ আফ্রিকাকে বিশ্বের বৃহত্তম সোনা উৎপাদনকারী দেশে পরিণত করেছিল।
সোনার খনি আবিষ্কারের ইতিহাস
১৮৮৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার উইটওয়াটারস্র্যান্ড (Witwatersrand) নামক স্থানে সোনার অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হয়। এই আবিষ্কারের পর পরই গোটা অঞ্চলটিতে খননকাজ শুরু হয় এবং খুব দ্রুতই এটি বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সোনার খনি অঞ্চলে পরিণত হয়। এই অঞ্চলেই অবস্থিত বিশ্বের দীর্ঘতম এবং গভীরতম সোনার খনিগুলির মধ্যে কিছু—যেমন মপোনেং (Mponeng) এবং টাওনগেন (TauTona)।

খনির গুরুত্ব এবং অর্থনৈতিক ভূমিকা
দক্ষিণ আফ্রিকার অর্থনীতি বহু বছর ধরে খনি শিল্পের ওপর নির্ভরশীল ছিল। সোনা রপ্তানি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম প্রধান উৎস ছিল। শুধু অর্থনীতিই নয়, দেশের অভ্যন্তরীণ শ্রমবাজার, শিল্প, পরিবহন ও নগরায়নের ক্ষেত্রেও খনি শিল্প একটি বিশাল ভূমিকা রেখেছে।
জোহানেসবার্গ শহর, যেটি দক্ষিণ আফ্রিকার বাণিজ্যিক রাজধানী, গড়ে উঠেছিল মূলত সোনার খনিগুলির আশপাশে শ্রমিকদের বসবাসকে কেন্দ্র করে।

শ্রমিকদের জীবন ও খনির ঝুঁকি
যদিও খনি শিল্প দক্ষিণ আফ্রিকার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, তবে এর সঙ্গে জড়িত ছিল বিপুল সামাজিক এবং মানবিক সমস্যা। খনির কাজ অত্যন্ত বিপজ্জনক ও কঠিন, এবং হাজার হাজার শ্রমিক এই কাজে প্রাণ হারিয়েছেন অথবা শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
বিশেষ করে বর্ণবৈষম্যের যুগে কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিকরা খনিতে অত্যন্ত অমানবিক পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য হতেন। আজও অনেক খনি অঞ্চলে স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

বর্তমান অবস্থা
বর্তমানে দক্ষিণ আফ্রিকার সোনা উৎপাদন অনেকটাই কমে এসেছে। অনেক পুরনো খনি বন্ধ হয়ে গেছে বা তাদের উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। মপোনেং খনি, যেটি বিশ্বের গভীরতম সোনার খনি (প্রায় ৪ কিমি গভীর), এখনও চালু আছে, কিন্তু উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে এবং খরচ বাড়ছে।
বার্ষিক উৎপাদন: একটি তুলনামূলক চিত্র
বছর | সোনা উৎপাদন (টন) | মন্তব্য |
১৯৭০ | ১,০০০ টন+ | ইতিহাসে সর্বোচ্চ; বিশ্বের ৭০% সোনা |
২০০০ | ~৪০০ টন | ধীরে ধীরে পতন শুরু |
২০১০ | ~১৮০ টন | আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা ও খরচ বৃদ্ধির প্রভাব |
২০২০ | ~৯০ টন | উৎপাদনে বড় ধস |
২০২৩ | ~৮৫ টন | ঘাটতি চলমান, চীন ও অস্ট্রেলিয়া শীর্ষে |
ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
১. পরিবেশ সংক্রান্ত উদ্বেগ: খনির কারণে জমি ধ্বংস, জল দূষণ এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষয় হয়েছে। এই সমস্যা রোধে পরিবেশবান্ধব খনন প্রযুক্তির দিকে মনোযোগ দিতে হচ্ছে।
২. দারিদ্র্য ও শ্রমিক কল্যাণ: বহু খনি শ্রমিক এখনও দরিদ্র, তাদের জন্য স্থায়ী ও সুরক্ষিত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা জরুরি।
৩. প্রযুক্তির ব্যবহার: আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে গভীর খনিতে নিরাপদে এবং দক্ষতার সঙ্গে সোনা উত্তোলন করা ভবিষ্যতের বড় চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা।
দক্ষিণ আফ্রিকার সোনার খনিগুলি শুধু একটি প্রাকৃতিক সম্পদই নয়, বরং একটি জাতির ইতিহাস, সংগ্রাম এবং সম্ভাবনার প্রতিচ্ছবি। অতীতের মতো ভবিষ্যতেও এই খনি শিল্প যদি সঠিকভাবে পরিচালিত হয়, তবে এটি আবার দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি শক্তিশালী স্তম্ভ হয়ে উঠতে পারে।