স্বাধীনতা সংগ্রামে বীরভূম

শম্ভুনাথ সেনঃ

“আগস্ট” মানে স্বাধীনতার মাস। নয়া প্রজন্মের কাছে মুক্তিসংগ্রামীদের নতুন করে চিনিয়ে দেওয়ার মাস। ব্রিটিশ পরাধীনতার শৃংখল থেকে মুক্তি আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল বীরভূম। আর তাই তো বীরভূম কার্যতই বীরভূমি। সেদিন বিট্রিশ বিরোধিতায় বীরভূমে সংঘটিত হয়েছিল একাধিক আন্দোলন। ১৮৫৫ সালে এই বীরভূম থেকেই সিধু-কানুর নেতৃত্বে সাঁওতাল বিদ্রোহের সূচনা হয়। আর এই বীরভূমকে বেছে নিয়েই স্বদেশী ভাবনার কর্মযজ্ঞের সূচনা করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। শান্তিনিকেতনে তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয় ছিল ইংরেজদের বিদ্যালয়ের এক পাল্টা প্রতিষ্ঠান। গান্ধীজী স্ত্রী সহ প্রথম শান্তিনিকেতনে আসেন ১৯১৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি। তাই এই দিনটি আজও “গান্ধী পুণ্যাহ” দিবস রূপে চিহ্নিত। গান্ধীজীর শান্তিনিকেতনে আগমন এবং তাঁর স্বরাজ ভাবনায় আন্দোলিত হয়েছিল সেদিনের বীরভূমের মা-মাটি-মানুষ। তাঁর স্বদেশী আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়েছিল বীরভূমের ছাত্রসমাজ। ১৯২১ সালের জানুয়ারীতে হেতমপুর কৃষ্ণচন্দ্র কলেজের ছাত্ররা একযোগে মহাবিদ্যালয় ত্যাগ করেন। সিউড়ি বেনীমাধব হাইস্কুলের সকল ছাত্ররা সেদিন পথে নামেন গান্ধীজীর আহ্বানে। এই বছরেই সিউড়ি, বোলপুর, সাঁইথিয়া, রামপুরহাট, মাড়গ্রাম প্রভৃতি স্থানে গড়ে তোলা হয় “স্বরাজ আশ্রম”। অসহযোগ আন্দোলনের প্রচারে জেলায় আসেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। সাঁইথিয়া, সিউড়ীতে তাঁর জনসভায় ভিড় উপচে পড়ে। স্বাধীনতা আন্দোলনে বীরভূমের “আমার কুটির”এর অবদান অনস্বীকার্য। ২৪পরগনার সুষেন মুখার্জী প্রতিষ্ঠিত বোলপুর সংলগ্ন বল্লভপুরে ১৯২৬ সালে প্রথম সুতিবস্ত্র ছাপার প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে ওঠে। এটির প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পান্নালাল দাশগুপ্ত। পরে তা বিপ্লবীদের আত্মগোপনের আশ্রয়স্থল হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যায়। সুষেন মুখার্জীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এখান থেকেই জেলায় জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ, সমাজ বিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। ১৯৩৮ সালের ৮ ডিসেম্বর নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস “আমার কুটির” পরিদর্শন করেন। বর্তমানে আমার কুটির বীরভূম মানচিত্রে পর্যটনকেন্দ্র রূপে চিহ্নিত। দৈনিক বহু পর্যটক আসেন অগ্নিযুগের সেই বিপ্লবীদের গোপন আশ্রয়স্থল দেখার জন্য। গান্ধীজীর “আইন অমান্য আন্দোলনের” ঢেউ এসে আছড়ে পড়েছিল বীরভূমেও। ১৯৩০ সালের মে মাসে হরতাল ও পিকেটিংয়ের মধ্য দিয়ে জেলায় আইন অমান্য শুরু হয়। ট্যাক্স বনধকে কেন্দ্র করে দুবরাজপুরে চাষীদের সঙ্গে বাঁধে পুলিশের সংঘর্ষ। শ্রমিক কংগ্রেসের জেলা সভাপতি সিউড়ির শরৎচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, জেলা কংগ্রেস সভাপতি নরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করলে জেলাব্যাপী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। বোলপুর, ইলামবাজার, নানুর, দুবরাজপুরে কংগ্রেসের দলীয় অফিসগুলিতে তল্লাশি চালিয়ে কয়েক’শো স্বেচ্ছাসেবীকে গ্রেপ্তার করে ব্রিটিশ পুলিশ। এইসব স্বাধীনতা সংগ্রামীদের তালিকায় ছিলেন সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, কামদাকিঙ্কর মুখোপাধ্যায়, রাইপুরের নিশাপতি মাঝি, খয়রাশোলের সুরেন্দ্রনাথ সরকার, দুবরাজপুরের জগদীশ চন্দ্র ঘোষ প্রমুখ। ১৯৪২ সালের ১৩ আগস্ট বীরভূম জেলা কংগ্রেস কমিটির সম্পাদক জাজিগ্রামের লালবিহারী সিং-এর নেতৃত্বে “ভারত ছাড়ো” আন্দোলনের সূচনা হয়। ১৫ আগস্ট দুবরাজপুরে সরজুপ্রসাদ গুপ্তের বাড়িতে গোপন সভায় জেলাকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পয়লা সেপ্টেম্বর দুবরাজপুর আদালত, ডাকঘরে আক্রমণ ও আগুন লাগানোর দায়ে “দুবরাজপুর হাঙ্গামা মামলায়” ৫৬ জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তাদের মধ্যে ছিলেন কুখুটিয়া গ্রামের কুমারিশ দাস, দুবরাজপুরের হারানচন্দ্র খাঙ্গার প্রমুখ। অন্যদিকে “বীরভূম রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র মামলায়” ৪২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ৩০৩ জন সাক্ষীর ৪০ দিন ধ’রে সাক্ষ্যগ্রহণের পর ১৯৩৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর রায় ঘোষণা করে সিউড়ি আদালত। লাভপুরের সত্যেন্দ্রনাথ গুপ্ত, সিউড়ি নিত্যগোপাল ভৌমিক, মল্লারপুরের ধরণীধর রায়, ময়ূরেশ্বরের দুর্গা ব্যানার্জি কারারুদ্ধ হন। বৈপ্লবিক কাজে লিপ্ত থাকার অভিযোগে বীরভূম থেকে আন্দামান সেলুলার জেলে পাঠানো হয় লাভপুরের প্রভাতকুসুম ঘোষ, নগরীর জ্যোতির্ময় রায়, আমোদপুরের রজতভূষণ দত্ত, নবগ্রামের বিজয় কুমার ঘোষ প্রমুখ জেলার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের। বীরভূমে মহিলা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের তালিকায় প্রথম নাম দুকড়িবালা চক্রবর্তী। নলহাটির ঝাউপাড়া গ্রামের খুব সাধারণ পরিবারের এক গৃহবধূ তিনি। সে সময় তাঁর বাড়ি হয়ে ওঠে বিপ্লবীদের আখড়া। বিপ্লবী দলে তিনি ‘মাসিমা’ নামে পরিচিত ছিলেন। বাড়িতে অস্ত্র রাখার অভিযোগে ১৯১৭ সালে অস্ত্র আইনে ধৃত পরাধীন ভারতের প্রথম মহিলা। বিচারে দু’বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়। তাছাড়া রামপুরহাটের নীহারিকা মজুমদার, দুবরাজপুর ব্লকের হালসোত গ্রামের সরোজিনী নায়ক, রাজনগর ব্লকের তাঁতিপাড়ার অহল্য দাসী, বোলপুরের রানী চন্দ্রদের নাম স্মরণযোগ্য। এই ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে পিছিয়ে পড়া বর্গের বহু মানুষ অংশ নিয়েছিলেন। তাঁদের তালিকায় দুবরাজপুরের আজবলাল সাহা, জাজিগ্রামের পশুপতি মাল, রামপতি রুইদাস, খয়রাশোলের ভূদেব দাস, গামারকুন্ডুর সিংরায় মুর্মু, রাম মাঝি, বোলপুরের জটা সরেন, চেরকা মাঝি, কুটে মাঝিদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে পরম্পরায়।বীরভূম জেলার বহু বিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয়েছে বীর বিপ্লবীদের নামে, যাতে তাঁরা জনপরিসরে বিস্মৃত না হন। দেশমাতৃকার পরাধীনতার শৃংখল মোচনে তাঁদের আত্মত্যাগ আমরা যেন ভুলে না যাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *