ছাত্র দরদী, স্কুল অন্ত প্রাণ সিদ্ধার্থ সিনহার বিদায় বেলায় চোখে জল ছাত্র ছাত্রী থেকে শিক্ষকদের

দীপক কুমার দাসঃ

স্কুল ওনার কাছে জীবন, আর ছাত্রছাত্রীরা ওনার প্রাণ, এমন ছাত্রদরদী পানুরিয়া প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক সিদ্ধার্থ সিনহার আজ বুধবার ছিল স্কুল জীবনের অবসরের দিন। সিদ্ধার্থ বাবুর সঙ্গে এই স্কুলের সম্পর্ক দীর্ঘ কুড়ি বছরের। আর দুদশকের শিক্ষকতা শেষে আজ অবসর নিলেন তিনি। এমন স্কুল অন্তঃপ্রাণ শিক্ষকের বিদায় বেলায় মন ভারাক্রান্ত সকলের। চোখে জল ছাত্র ছাত্রীদের। সিদ্ধার্থ সিনহার শিক্ষক জীবনের শুরু ২৮ জুন, ২০০০ সালে মেটেলা প্রাইমারি স্কুলে। পরে বদলি হয়ে যোগ দেন সিউড়ি সার্কেলের পানুরিয়া প্রাইমারি স্কুলে। তখন স্কুলে ব্লিডিং বলতে ভগ্নপ্রায় রুম। চারদিকে ধূধূ ফাঁকা মাঠ। নেই কোন শৌচাগার। শিক্ষিকাদেরও শৌচকর্ম করতে যেতে দূরে মাঠের ধারে। এমন অবস্থায় স্কুলের প্রধান শিক্ষককে নিয়ে উদ্যোগ নেন স্কুলের উন্নয়ন কাজে। সরকারী অনুদান পেয়ে তৈরী হয় নতুন ব্লিডিং, শৌচাগার। মূল উদ্যোগ মাথায় নিয়ে সাজিয়ে তোলেন পানুরিয়া প্রাইমারি স্কুলটিকে। স্কুলের মধ্যে ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে গড়ে তোলেন ফুল ফলের বাগান। কখনো নিজের টাকায় কিনে আনেন মরশুমী ফুলের চারা, বিভিন্ন ফলের চারা সার বীজ। বর্তমানে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত এই বিদ্যালয়ে ছাত্র ছাত্রী ১৬৫জন। মোট ৬জন শিক্ষক। স্কুলের ভিতরেই ফলের বাগান। সেখানে আম, জাম, কাঁঠাল, আঁতা, বেল, হরিতকী, আমলকী, কলা সহ বিভিন্ন প্রজাতির ফলের গাছ। আর এই সব ছাত্র ছাত্রীদের কথা ভেবে। আর এই ভাবনা শিক্ষক সিদ্ধার্থ সিনহার। সময়ের বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন, শৃঙ্খলাপরায়ণ, দ্বায়িত্বশীল সমাজসেবী, উদ্যোগী শিক্ষক সিদ্ধার্থ সিনহা। সহ শিক্ষকরাও সবাই এককথায় স্বীকার করে নিয়েছেন সব কাজের ব্যাপারে মূল উদ্যোগ ওনার। সময়, শ্রম ও দ্বায়িত্ব নিয়ে তিলে তিলে সাজিয়ে তুলেছেন পানুরিয়া প্রাইমারি স্কুলকে। ছাত্র ছাত্রীদের জন্য দিয়েছেন সুন্দর এক পরিবেশ। খেলার মাঠকে খেলার উপযোগী করে তুলেছেন আন্তরিকতার সঙ্গে। স্কুলছুট ছাত্র ছাত্রীদের ও বিদ্যালয়মুখী করে তুলেছেন, ছাত্র ছাত্রীদের সঙ্গে সাবলীলভাবে মিশে গেছেন। ওদের মনে গেঁথে দিয়েছেন স্কুলটা আমাদের। এভাবেই উনি যেন সবার অভিভাবক হয়ে গেছেন। সিউড়ির রবীন্দ্রপল্লীতে বসবাস। বিশিষ্ট ব্যবসায়ীও। কিন্তু স্কুলের জন্য তিনি নিবেদিত প্রাণ। বর্তমান প্রধান শিক্ষক স্বরাজ কুমার সেন বলেন, “আমি ২০০৬সালে এই স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দিই। তখন থেকেই দেখছি সিদ্ধার্থ সিনহার স্কুলের প্রতি এত দরদ, ধৈর্য্য, নিষ্ঠা, কাজ করার অদম্য ইচ্ছা, সময়ানুবর্তিতা, পরোপকারী-এরকম মানুষ পাওয়া দুর্লভ। কখনো কখনো মত পার্থক্য হলেও সেটা সহজেই মিটে যেত। কোনো সমস্যা এলে সেটা সহজেই সমাধান করে দিতেন উনি। আজ ওনার শিক্ষক জীবনের অবসরের দিন। এই বিদায় বেলায় মনে হচ্ছে আমরা অভিভাবকহীন হয়ে গেলাম। মনে হচ্ছে বুকের ভিতরটা ফাঁকা হয়ে গেল”। এই স্কুলের সহ শিক্ষিকা ফুলমণি হেমব্রম বলেন, “যখন এই স্কুলে যোগ দিই তখন পুরনো ব্লিডিং, খাঁ খাঁ মাঠ, শৌচাগার নেই। সিদ্ধার্থ সিনহা মূল উদ্যোগ নিয়ে সরকারী তহবিলের টাকায় স্কুলটা সাজিয়ে তোলেন। আর নিজের টাকাও খরচ করে সুন্দর পরিবেশ তৈরি করে তোলেন। খেলার নীচু মাঠে মাটি ভরিয়ে সেটা খেলার উপযোগী করে তোলার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্কুল ছুট ছাত্রদের স্কুলমুখী করেন। শুধু ওনার জন্যই বদলে গেছে স্কুলের পরিবেশ। ছাত্র ছাত্রী থেকে শিক্ষক শিক্ষিকাদের সবাইকে উনি একটি পরিবার করে তুলেছেন। ওনার মতো এমন ছাত্রদরদী শিক্ষক খুব কম”। ছাত্র ছাত্রীদের কাছেও খুব প্রিয় তাদের সিদ্ধার্থ স্যার। ছাত্র ছাত্রীদের সঙ্গে বয়সের ব্যবধান অনেক থাকলেও অনায়াসে ওদের সঙ্গে মিশে যেতেন। আরেক শিক্ষিকা স্মিতা মুখার্জী বলেন, “উনি ভীষণ জনদরদী মানুষ। আর ওনার কাছে স্কুলটাই জীবন। প্রয়োজনে রবিবার বা ছুটির দিনেও স্কুলে এসেছেন। স্কুল আর ছাত্র ছাত্রী ছাড়া কিছু বোঝেন না। ওনার জন্যই স্কুলের পরিবেশ বদলে গেছে। ষ্টাফ রুমের পরিবেশও সদর্থক। ছাত্র ছাত্রীদের উনি বোঝাতে পেরেছেন স্কুলটা ওদের সবার। সকলের কাছে তিনি একটা উদাহরণ। ওনার বিদায়ে স্কুলের সঙ্গে খাতায় কলমে সম্পর্ক শেষ হলেও আমাদের আত্মার সম্পর্ক শেষ হচ্ছে না”। আরেক শিক্ষিক সুমন ঘোষ জানান, স্কুলের সৌন্দয্যায়ণ ও খেলার মাঠ তৈরিতে ওনার অবদান অনস্বীকার্য। মিড ডে মিলে ছাত্র ছাত্রীদের হাতে লাগানো গাছের সব্জি খাইয়েছেন। ফল পেড়ে সব ছাত্র ছাত্রীদের দিয়েছেন। স্কুলে ক্যারাটে ও যোগাসন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। আজ ওনার শিক্ষক জীবনের বিদায়বেলায় মনে হচ্ছে আমরা অভিভাবকহীন হয়ে গেলাম। উনি ছাত্র ছাত্রী থেকে সকলের কাছে একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকলেন”। সিদ্ধার্থ সিনহার শিক্ষক জীবনের অবসরের দিনটিকে স্মরণ করে রাখতে আজ বুধবার দুপুরে ছাত্র ছাত্রী থেকে শিক্ষক শিক্ষিকাদের মধ্যাহ্ণ ভোজনের ব্যবস্থা করা হয়। একটি ছোট্ট অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। শিক্ষক শিক্ষিকাদের পক্ষ থেকে ওনার হাতে বিভিন্ন উপহার তুলে দেওয়া হয়। এমন ছাত্রদরদী শিক্ষকের বিদায়বেলায় মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে পড়ুয়াদের। বিদায় লগ্নে চোখে জল ছাত্র ছাত্রী থেকে শিক্ষক শিক্ষিকাদেরও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এআই শিখুন, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এগিয়ে যান!


এআই কোর্স: ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, শিক্ষক এবং ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য সম্পূর্ণ গাইড! Zed Age Infotech এর তরফ থেকে প্রথমবার বীরভূম জেলায়! আপনি কি ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, শিক্ষক নাকি ছাত্র/ছাত্রী? আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) আপনার কাজ এবং লেখাপড়াকে আরও সহজ এবং কার্যকর করতে পারে! Zed Age Infotech এর নতুন এআই কোর্সে যোগ দিন! বিশদ জানতে কল করুন 9474413998 নম্বরে অথবা নাম নথিভুক্ত করতে নীচের লিঙ্কে ক্লিক করুন।

This will close in 120 seconds