দেবব্রত-মানবেন্দ্রের ছাত্র হিসেবে নিজেকে ধন্য মনে করি—-শিবাজী পাল

চন্দন চট্টোপাধ্যায়ঃ

বাড়ির নাম ‘কোমল গান্ধার’। এই কোমলতা শুধু তাঁর বাড়িতে নয়, ধারণ করে আছেন হৃদয়ে এবং ব্যবহারিক আচরণেতে। প্রায় সাড়ে সাত দশকের একটি জীবন যেমন সুর-তাল-লয়ে আবর্তিত হয়েছে, তেমনি দিলদরাজ হয়ে উঠেছে সামাজিক কল্যানকর দায়বদ্ধতায়। মিষ্টভাষী অথচ স্পষ্টবাদী, স্বভাব বিনম্র অথচ দৃঢ়চেতা এই মানুষটি হলেন বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী শিবাজী পাল। পেশায় ছিলেন আদালত কর্মী, কিন্তু নেশায় সুরসাধক। রবীন্দ্র-নজরুল-আধুনিক এবং শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তাঁর অবাধ এবং সমৃদ্ধ বিচরণ। বাংলা গানের জগতে তিনি ‘দেবব্রতের ছায়া’ নামেই সমধিক পরিচিত। গত ২৪ সেপ্টেম্বর (২০২২) শনিবারের ঝলমলে শারদ-সকালে তাঁর সঙ্গে অমূল্য কিছুক্ষণ সময় কাটালেন কবি চন্দন চট্টোপাধ্যায়, তাঁরই সিউড়ি কল্পতরুপল্লীর বাড়িতে।
চন্দনঃ– নমস্কার শিবাজীদা। আপনার সঙ্গীত জীবনের শুরু কোন বয়সে?
শিবাজীঃ– গানের প্রতি আকর্ষণ আমার ছোটো থেকেই। বিশেষত রবীন্দ্র সঙ্গীত আমার প্রথম প্রেম বলতে পারো। আমার গানের তালিম শুরু খ্যাতনামা শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পী জগন্নাথ মাজির কাছে। তারপর বিশ্বভারতী সঙ্গীত ভবনের শিক্ষক ভি-ভি ওয়াজলওয়া এবং অলোক চট্টোপাধ্যায়ের প্রশিক্ষণ আমার সঙ্গীত জীবনে তুমুল প্রভাব ফেলে।
চন্দনঃ–শুনেছি দেবব্রত বিশ্বাস এবং মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ছাত্র ছিলেন আপনি?
শিবাজীঃ– হ্যাঁ ঠিকই শুনেছো। ওটা ছিল আমার সঙ্গীত জীবনের সুবর্ণযুগ। এক শুভাকাঙ্খীর মাধ্যমে জর্জদার সঙ্গে আলাপ। তিনি আমার গান শুনে কী বুঝলেন কী জানি, বললেন, ‘আমি তোমাকে রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখাবো, চলে এসো’। টানা ১১ বছর ধরে তাঁর কাছে গান শিখে আমার রবীন্দ্রসঙ্গীত-চেতনার যেন পুনর্জন্ম হল।
চন্দনঃ–এই যে চেতনার পুনর্জন্ম কথাটি বললেন, তা আর পাঁচজন শিল্পীর সঙ্গে দেবব্রত বিশ্বাসের তফাত্ কী কী?
শিবাজীঃ– (হেসে) আকাশ আর পাতাল! আসলে রবীন্দ্রসঙ্গীত হল কথাপ্রধান গান। গানের ভাষা, ভাব ও অন্তর্নিহিত আবেদনটা বুঝতে না পারলে পরিবেশনের স্বতঃস্ফূর্ততা আসে না। গানের আবেদন শ্রোতাদের সন্তুষ্ট করতে পারে না। জর্জদার ……. এবং উপলব্ধি এক্ষেত্রে যুগান্তকারী। এর সঙ্গে ছিল তাঁর নিখুঁত উচ্চারণ। কন্ঠ মাধুর্য, পরিবেশন শৈলী, এবং সঙ্গীত-প্রজ্ঞার নিরিখে দেবব্রতের প্রতিভা বিশ্বে বিরল বলে মনে করি।
চন্দনঃ–আর মানবেন্দ্রর সঙ্গে আলাপ?
শিবাজীঃ– ওঁর সঙ্গে আলাপ আমি নিজে থেকেই করেছিলাম। আশির দশকের শুরুতে একদিন ঠিকানা জোগাড় করে চলে গেছিলাম ওঁর কোলকাতার বাড়িতে। দীর্ঘ ৪ ঘন্টা ধরে আলোচনা প্রথম আলাপেই ঘনিষ্ঠতা। প্রায় ১০ বছর তাঁর কাছে শিখেছি। আমাকে ভীষণ বিশ্বাস করতেন। নজরুল গীতি ও আধুনিক গানে উনি আমাকে নতুন দিশা দেখিয়েছেন।
চন্দনঃ–এঁদের ছাড়া আরও তো অনেক বিখ্যাত শিল্পীর সান্নিধ্য পেয়েছেন….
শিবাজীঃ– হ্যাঁ, সেবিষয়ে সুকুমার সমাজপতির নাম বলতেই হয়। ইস্টবেঙ্গল দলের অধিনায়ক ছিলেন, পাশাপাশি একজন বিশিষ্ট শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পীও। এছাড়া শিল্পী ও ভাস্কর শর্বরী রায়চৌধুরী, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়, হেমন্ত, জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, রামকুমার চট্টোপাধ্যায়রা তো আছেনই, এমনকি মান্না দের সঙ্গেও একই মঞ্চে গান করেছি। ওঁদের দেখে অনেককিছু শিখেছি।
চন্দনঃ–এখনকার কার কার গান ভালো লাগে আপনার?
শিবাজীঃ– তেমনভাবে কারো গান আর আমাকে টানেনা। শুভমিতা, শম্পা কুন্ডু, শ্রীরাধার মতো কয়েকজন শিল্পীর গান ভালোই লাগতো/তবে এখন তাদের আর তেমন ভাবে পাওয়া যায় না।
চন্দনঃ–এই যে বললেন ‘আমাকে আর টানেনা’, তা কেন?
শিবাজীঃ– রবীন্দ্র সঙ্গীতের মানের অবনমন। তবলা, হারমোনিয়ামের প্রাধান্য কমছে, বিদেশী নানা বাদ্যযন্ত্রের আমদানি। শিল্পীদের মধ্যে অনেকেরই ব্যবসায়িক ভাবনা বেড়ে গেছে। তারা গায় কিন্তু বোঝে কম। শেখানোর প্রবনতা বেশী, কিন্তু শেখার আগ্রহ কম। উচ্চারণ ঠিক হয় না, যেন সুর করে কবিতা বলছে! ব্রেণলেস্ পরিবেশন।
চন্দনঃ–এখনকার প্রজন্মের শিল্পীদের জন্য কিছু পরামর্শ?
শিবাজীঃ– এরা খুব প্রচারের আলোয় আসার জন্য তাড়াহুড়ো করে। রাতারাতি মঞ্চ ব্যবহার, উপার্জন, পুরস্কার…. আরে অধ্যয়ন কই? সাধনা কই? নিষ্ঠা, শ্রম আর অধ্যবসায় থাকলে টাকা, পুরস্কার, প্রচার, সুনাম সব আপনা আপনি আসবে। সেটা বুঝতে হবে আগে।
চন্দনঃ–শুনেছি এইচ.এম.ভি থেকে আপনাকে ডাকা হয়েছিল, আপনি যাননি….
শিবাজীঃ-– হ্যাঁ যাইনি। ওরা আমাকে কোলকাতায় স্থায়ী ভাবে থাকতে হবে বলেছিল। কিন্তু চাকরি, সামাজিক-সাংসারিক বিভিন্ন দায়, আমার যাবার উপায় ছিল না। তবে নব্বইয়ের দশকে আমার দুটি আধুনিক গানের ক্যাসেট বেড়িয়েছে, বেড়িয়েছে একটি একক রবীন্দ্র সঙ্গীতের ক্যাসেটও।
চন্দনঃ–জীবনের সেরা আনন্দের ঘটনা কি?
শিবাজীঃ– নিঃসন্দেহে দেবব্রত-মানবেন্দ্র সান্নিধ্য।
চন্দনঃ–আর জীবনের সবচেয়ে দুঃখ?
শিবাজীঃ– নেই। দুঃখকে জীবনে স্থান দিতে চাইনি। অকারণে দুঃখ পাওয়া মানে তো হেরে যাওয়া! মানুষ দুঃখ পায় এমন কোনও কাজ আমি করিনি, করতে চাইও না!
চন্দনঃ–গান সম্পর্কে এত জ্ঞান, এত খ্যাতি-তা আপনি সঙ্গীত প্রশিক্ষনের পথে গেলেন না কেন?
শিবাজীঃ– না। ইচ্ছা হল না তাই। আমৃত্যু নিজেকে নিয়েই থাকবো ঠিক করেছি। গানে আর সুরে খুঁজে বেড়াবো ‘আপনার চেয়ে আপন যে জন..’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এআই শিখুন, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এগিয়ে যান!


এআই কোর্স: ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, শিক্ষক এবং ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য সম্পূর্ণ গাইড! Zed Age Infotech এর তরফ থেকে প্রথমবার বীরভূম জেলায়! আপনি কি ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, শিক্ষক নাকি ছাত্র/ছাত্রী? আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) আপনার কাজ এবং লেখাপড়াকে আরও সহজ এবং কার্যকর করতে পারে! Zed Age Infotech এর নতুন এআই কোর্সে যোগ দিন! বিশদ জানতে কল করুন 9474413998 নম্বরে অথবা নাম নথিভুক্ত করতে নীচের লিঙ্কে ক্লিক করুন।

This will close in 120 seconds