উত্তম মণ্ডলঃ
ডান পা সামনে থাকলে, তিনি দক্ষিণা কালী। এই দক্ষিণা কালীর মূর্তি প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িত আছে একটি কাহিনী। কাহিনীটার উৎসভূমি নদীয়া জেলার নবদ্বীপ। সময়টা খ্রিস্টিয় সপ্তদশ শতক। এই সময়ে নদীয়ার নবদ্বীপে সম্ভবত ১৫৩৩ থেকে ১৬০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ সময়ে কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ নামে একজন মহান তন্ত্রসাধকের জন্ম হয়। শোনা যায়, তিনি ছিলেন শ্রীচৈতন্যের বন্ধু। দু’জনেই নবদ্বীপের মানুষ, কিন্তু দু’জনের সাধন পথ ছিল ভিন্ন। বাংলায় তখনো পর্যন্ত দেবী কালীকে অতি উগ্র স্বভাবের দেবী হিসেবে দেখা হতো বলে কোন গৃহে তাঁর পুজো করা হতো না। তাঁর কোন সাকার রূপটিও তখনও পর্যন্ত তৈরি হয়নি। দেবীর পুজো হতো যন্ত্রে ও শিলা খণ্ডে, গহন অরণ্যে, কিংবা কোন নদী উপকূলের কোনো নির্জনে। তখনো দেবী কালী ঘরের মেয়ে হয়ে ওঠেন নি।
সাধক কৃষ্ণানন্দ চাইলেন, দেবীকে নিরাকার থেকে আকার দিতে। কিন্তু তিনি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলেন না, মাতৃমূর্তির রূপ কি রকম হতে পারে। এরপর যতদিন গড়ায়, সাধকের মন মায়ের রূপ দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। দিনরাত একটাই আকুতি তা়ঁর, মা আমি তোমাকে সাকারে চাই। দর্শন করতে চাই তোমার রূপ।
এরপর ঘটে গেল এক ঘটনা। এক রাতে অর্ধ ঘুমন্ত অবস্থায় দৈব বাণী শুনলেন কৃষ্ণানন্দ, মহানিশার অবসানে প্রাতঃমুহূর্তে কৃষ্ণানন্দ প্রথম যে নারীমূর্তি দর্শন করবেন, সেই মূর্তিই হবে ইচ্ছাময়ীর যথার্থ সাকার মূর্তি। পরের দিন ভোরে গঙ্গাস্নানে বেরিয়ে কৃষ্ণানন্দ দেখলেন, এক দরিদ্র গ্রাম্য বধূ গাছের গুঁড়ির উপর নিবিষ্ট মনে ঘুঁটে দিচ্ছেন। বাঁ হাতে ধরা গোবরের মস্ত তাল, ডান হাত উঁচুতে তুলে ঘুঁটে দিচ্ছেন তিনি। নিচু জাতের মেয়ে, গায়ের রং কালো, আলুথালু বেশভূষা, পিঠে আলুলায়িত ঘন চুলের রাশি, কনুই দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে গিয়ে সিঁদুর লেপ্টে গেছে। এই অবস্থায় পরপুরুষ কৃষ্ণানন্দকে দেখে লজ্জায় জিভ কাটলেন সেই ঘুঁটে দেওয়া অচেনা বধু। ততক্ষণে কৃষ্ণানন্দ যা বোঝার বুঝে গিয়েছেন। তিনি এই ছবিটিই মানসপটে এঁকে গঙ্গামাটি দিয়ে মূর্তি গড়ে ফেললেন কৃষ্ণানন্দ। কৃষ্ণানন্দের এই মূর্তিই পরবর্তীতে দক্ষিণা কালী হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠলো বাংলায়। নবদ্বীপ পোড়া মা তলায় এখনো রয়েছেন “আগমবাগীশের কালী।”